মানবতার মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা: নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর তাঁর মক্কী জীবনের শেষ দিকে, মতান্তরে হিজরতের তিন বছর আগে রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতে তিনি জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে বোরাক নামক বাহনযোগে মক্কা মুকাররমা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে রফরফ যোগে ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টির অনন্ত রহস্য অবলোকন ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করেন। এরপর বায়তুল মুকাদ্দাস ফিরে এসে সব নবী-রাসূলের ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করে মক্কায় ফিরে আসেন।
নবীজির মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের ভ্রমণকে ‘ইসরা’ এবং বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণকে ‘মিরাজ’ বলা হয়। মিরাজ আরবি শব্দ, যার অর্থ ওপরে ওঠার সিঁড়ি বা সোপান। ইসরা সম্পর্কে আল কুরআনের ১৭নং সূরা ইসরা বা বনি ইসরাঈলের প্রথম আয়াতে ‘(পবিত্র ও মহামহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের একটি অংশে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম বায়তুল্লাহ হতে মসজিদুল আকসা বায়তুল মুকাদ্দাসে, যার পরিবেশ আমি আল্লাহ বরকতময় করেছিলাম তাঁকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য)’ এবং মিরাজ সম্পর্কে সূরা আন নাজমের ৮ থেকে ১০ এবং ১৩ থেকে ১৮ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। কুরআনের পাশাপাশি বহুসংখ্যক বিশুদ্ধ হাদিসেও ইসরা ও মিরাজের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
প্রখ্যাত ফরাসি চিকিৎসক ও চিন্তাবিদ মরিস বুকাইলি (১৯২০-১৯৯৮) তার The Bible. The Qur’an and Science (১৯৭৬) গ্রন্থে কুরআনে বর্ণিত তথ্য অকাট্য এবং সেখানে কল্পনার কোনো স্থান নেই বলে অভিমত রেখেছেন। তিনি কুরআনে বর্ণিত ‘অলৌকিক’ ঘটনাবলীর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রমাণের প্রয়াসও পেয়েছেন। আল কুরআনে ইসরা ও মিরাজের মতো এমন আরো বাস্তব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যেমন হজরত মুসা আ:-এর দলবলসহ হেঁটে নীলনদ পার হওয়ার ঘটনা (সূরা আরাফ), হজরত ইবরাহিম আ:-এর নমরুদের বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া (সূরা আম্বিয়া আয়াত ৬৮-৬৯), হজরত ঈসা আ:-এর উম্মতের জন্য আকাশ থেকে গায়েবি খাদ্য মান্না ও সালওয়া নামিয়ে দেয়া (সূরা বাকারা ৫৭ আয়াত), হজরত ঈসা আ:-এর উম্মতের জন্য খাদ্যসজ্জিত টেবিল আকাশ থেকে নামিয়ে দেয়া (সূরা মায়েদা ১১২-১৩ আয়াত), হজরত সুলাইমান আ:-এর নির্দেশে কিতাবের জ্ঞানী এক ব্যক্তিত্ব রানী বিলকিসের সিংহাসনকে চোখের পলকে ইয়েমেন থেকে উঠিয়ে আনা (সূরা নামল, আয়াত ৪০)।
১৪০০ বছর আগে রাসূল আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পাঁচ হাজার বছরের পথ মুহূর্তের মধ্যে ভ্রমণ করে ফিরে আসার ঘটনা জগতের চিন্তাশীল ও বিজ্ঞানীদের গবেষণাকর্মের প্রেরণাকে প্রজ্বলিত করে। মহাকাশ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা এবং চিন্তাভাবনা বহু আগে থেকে থাকলেও মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সশরীরে মহাকাশ অভিযান শুরু হয় বিশ শতকের পাঁচের দশকে। এ অভিযানে প্রথম ভ্রমণ শেষে (অ্যাপোলো ১১ নভোযানে) নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখেন। আধুনিক যুগের মানুষ মহাশূন্য পাড়ি দিচ্ছে। মানুষ এখন পৃথিবী থেকে সাড়ে তিন কোটি মাইল দূরের মঙ্গল গ্রহেও বসবাসের চিন্তা করছে।
বিজ্ঞানময় কুরআন, পদার্থবিজ্ঞান, মহাজাগতিক বিজ্ঞান, আলোক বিজ্ঞান গতি বিজ্ঞানসহ সময়ের সর্বশেষ গবেষণালব্ধ ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে ইসরা ও মিরাজের সত্যতা স্পষ্ট ও সুপ্রমাণিত। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, ঘণ্টায় ২৫ হাজার মাইল বেগে ঊর্ধ্বলোকে ছুটতে পারলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। এক সময় মনে করা হতো পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে গমন সম্ভব নয়। কিন্তু এখন প্রমাণিত হয়েছে শূন্যে অবস্থিত কোনো স্থূল বস্তুকে পৃথিবী সব সময় সমভাবে আকর্ষণ করতে পারে না। কেননা প্রত্যেক গ্রহের একটি নিজস্ব আকর্ষণী শক্তি আছে। পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এমন একটা স্থান আছে যেখানে কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই। তাই পৃথিবীর কোনো বস্তু যদি এই নিউট্রন জোনে পৌঁছতে পারে অথবা এই সীমানা অতিক্রম করে সূর্যের সীমানায় পৌঁছে যেতে পারে তবে তার আর পৃথিবীতে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। গতিবিজ্ঞান স্থির করেছে, পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুকে যদি প্রতি সেকেন্ড ৬.৯০ অর্থাৎ মোটামুটি সাত মাইল বেগে ঊর্ধলোকে ছুড়ে দেয়া যায়, তবে তা আর পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই।
বোরাক আরবি বারকু শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো বিদ্যুৎ (Electricity) আর রফরফ-এর আভিধানিক অর্থ নরম তুলতুলে, সবুজ বিছানা। রফরফ হলো বোরাকের চেয়েও শক্তিশালী, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। বোরাক এবং রফরফ এর গতি আলো বা বিদ্যুতের চেয়ে বেশি ছিল বলেই নবীর পক্ষে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করা সম্পূর্ণ সম্ভব ছিল। গতির তারতম্যে সময়ের তারতম্য ঘটে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন, আলোর গতির যতই কাছে যাওয়া যায় সময় ততই শ্লথ হয়ে আসে এবং আলোর গতি অপেক্ষা বেশি দ্রুতগতি হলে সময় উল্টা দিকে প্রবাহিত হয়। রাসূলের বাহনের গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি ছিল বলেই অল্প সময়ের মধ্যে ইসরা ও মিরাজের মতো বড় ও দীর্ঘ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছিল। স্থান, কাল, জগৎ সব কিছুই গতির ওপর নির্ভরশীল। চোখের পলকে লাখ কোটি মাইল পথ অতিক্রম করার ক্ষমতা আল্লাহ পাক বোরাক ও রফরফকে দিয়েছেন। সূর্যরশ্মির চেয়েও ক্ষিপ্র রফরফের গতিবেগ। এটা নূরের তৈরি জান্নাতি বাহন। আলোর গতিবেগ অপেক্ষা অনেক বেশি অর্থাৎ এর গতি অকল্পনীয় দ্রুত। বিদ্যুৎ বা আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল। বোরাকের গতি এর চেয়েও দ্রুত হওয়ার কারণেই অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে রাসূলের সপ্তাকাশ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছে। নবীজির মিরাজ সশরীরে হয়েছিল বলেই বোরাক ও রফরফের মতো বাহন ব্যবহৃত হয়েছিল।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান
সোর্স : নয়া দিগন্ত