যন্ত্র ছাড়া এভাবেই সাদা চোখে দেখে বিদেশে রপ্তানি করা হয় কৃষিপণ্য -সমকাল
শরীয়তপুরের জাজিরার মিরাশার চাষি বাজারে বসে সবচেয়ে বড় সবজির হাট। কৃষকরা নিজেদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন এ হাটে। আঞ্চলিক বাজার হওয়ায় শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ফসলের ন্যায্য দামটা পান না তাঁরা। তবে এ বছরের জানুয়ারিতে উৎপাদিত সবজি ইউরোপে যাওয়ার মাধ্যমে খুলেছে চাষির ভাগ্য।
জাজিরার মতো বিভিন্ন অঞ্চলের সবিজ ও ফলমূলের বিদেশযাত্রায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটলেও সে পথ মসৃণ নয়। ঢাকার শ্যামপুরে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউসে যন্ত্র ছাড়াই পরীক্ষা হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য পণ্য। সাদা চোখে পণ্য দেখে বিদেশে পাঠানোর কারণে মাঝেমধ্যে ফেরত আসছে।
পড়তে হচ্ছে নিষিদ্ধের জালে। বিপত্তিতে পড়ছেন রপ্তানিকারকরা। অবশষে সেই সনাতন পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। দক্ষ জনবলের অভাবে এতদিন অলস পড়ে থাকা যন্ত্র আবার সক্রিয় হচ্ছে। এখন থেকে কৃষিপণ্য পরীক্ষা ও প্যাক করা হবে আধুনিক পদ্ধতিতে। সে লক্ষ্যে প্রায় এক যুগ আগে নির্মিত সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউসকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিতে কাজ চলছে পুরোদমে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণাঙ্গাভাবে চালুর আশা করছেন সংশ্নিষ্টরা।
যেভাবে হোঁচট খেয়েছে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউস : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১৮৯ কোটি টাকা খরচ করে ‘বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সালে সবজি ও ফলমূল রপ্তানির পথ সুগম করা এবং কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পুরান ঢাকার শ্যামপুর বিসিক শিল্পনগরীতে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউস নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের ১৬ মে ইউরোপে আম রপ্তানির জন্য এটি চালু করা হয়েছিল আংশিকভাবে।
তবে দক্ষ জনবলের অভাবে ফল ও সবজি মোড়কজাত করার আধুনিক সুযোগ-সুবিধার প্যাকিং হাউসটি পুরোদমে চালু করা করা যায়নি। আধুনিক যন্ত্র এনেও প্রশিক্ষত দক্ষ লোকবলের অভাবে তা এখনও পড়ে আছে। এখনও কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই চোখে দেখে সনাতন পদ্ধতিতে পণ্যের মান যাচাই করে বিদেশ পাঠানো হচ্ছে। এতে ইউরোপে কৃষিপণ্য রপ্তানির পর সবজি বা ফলমূলে পোকামাকড় ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়ায় মাঝেমধ্যে তা ফেরত আসছে। রাশিয়ায় মানহীন আলু ও ইউরোপে পান রপ্তানি নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইংয়ের তথ্য বলছে, ৪৫ ধরনের ৭০টি যন্ত্রপাতি কিনতে খরচ করা হয় ৬০ কোটি টাকারও বেশি। তবে দক্ষ জনবল না থাকায় ল্যাবটি চালু হয়নি। প্রশিক্ষণ নেওয়া কর্মকর্তারা পদোন্নতি বা বদলির কারণে প্যাকিং হাউস ছেড়ে চলে যাওয়ায় অলস পড়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটির আধুনিক যন্ত্রপাতি।
নতুন যাত্রা শুরু : পুরোনো সেই ভুল মাথায় নিয়ে এবার নতুন আঙ্গিকে শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসের কার্যক্রম। এ অবস্থায় বিশ্ববাজারে দেশের কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে শ্যামপুরে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ গবেষণাগারকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেই লক্ষ্যে ‘কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর’ শীর্ষক ১৫৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পল্গ্যান্ট কোয়ারেন্টাইন উইংয়ের উপপরিচালক ড. জগৎ চাঁদ মালাকার।
নতুন সেই স্বপ্নযাত্রা কেমন চলছে- গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে গেলেই চোখে পড়ে এক সময়ের জীর্ণ ভবন বদলে যাওয়ার চাপ। পুরো ভবনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। নতুন করে নির্মাণ হয়েছে সীমানা প্রাচীর। সুসজ্জিত অফিস কক্ষ। তিনতলা ভবনের নিচতলায় সবজি ও ফলমূলের মান যাচাই-বাছাই, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া ও শুকানো এবং মোড়কজাত করার জন্য আলাদা অত্যাধুনিক কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। দোতলায়ও আছে একই ব্যবস্থা। আছে ২০০০ কেজি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কার্গো লিফট। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের জন্য নিচতলা ও দোতলায় রয়েছে কয়েকটি শীতলীকরণ (কুলিং) কক্ষ।
ভবনের তৃতীয় তলায় কর্মকর্তাদের জন্য কার্যালয়, রপ্তানিকারকদের প্রশিক্ষণের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ কক্ষ ও একটি সভাকক্ষ তৈরির কাজ চলছে। এ ছাড়া নির্মাণ হচ্ছে ১০টি ল্যাব। সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য জেনারেটরও আছে, রয়েছে নিজস্ব পাওয়ার স্টেশনও। ভবনের বেসমেন্টে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতিথিদের বিশ্রামের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত কক্ষ। ইউরোপের যে কোনো দেশে সবজি ও ফলমূল রপ্তানির জন্য দূষণ, কীটনাশকের রেসিডিউ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ রয়েছে কিনা- বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করা যাবে এখানে। আগের কেনা যন্ত্রের পাশাপাশি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য আরও যন্ত্রপাতি কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী দুয়েক মাসের জন্য এ জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক ড. জগৎ চাঁদ মালাকার।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসের কাজ শেষ হওয়ার আশা করা হচ্ছে। এর পর কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে। সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউসের ল্যাব টেস্টের ওপর বিদেশের বাজার জয় করা নির্ভর করছে। ফলে সব কাজ অত্যন্ত যত্ন ও স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হচ্ছে। কোনোরকম ত্রুটি রাখা হচ্ছে না। এরই মধ্যে অবকাঠামোগত ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
নতুন প্রকল্পের মূল্যায়নের জন্য কৃষিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তরা পরিদর্শনের পর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
জনবল সংকট : প্যাকিং হাউসটির জন্য ১৯ পদে জনবল চাওয়া হলেও মঞ্জুর হয় ১৩টি। বর্তমানে আছেন মাত্র ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। খালি পড়ে আছে নৈশপ্রহরী, চালক, ক্লিনারসহ অনেক পদ। জনবল স্বল্পতার কারণে বর্তমানে নিজেদের শ্রমিকদের দিয়েই পণ্য ধোয়া, শুকানো কিংবা প্যাকিংয়ের কাজ করাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। এখানে কর্মকর্তাদের জন্য নেই আলাদা থাকার ব্যবস্থা।
সংশ্নিষ্টরা জানান, শুধু আধুনিক ল্যাব ও প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, প্রশিক্ষিত জনবলকে প্যাকিং হাউসে দীর্ঘ সময় ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য রাখতে হবে নানা সুবিধা। প্রয়োজনে আলাদা কর্তৃপক্ষ করারও দাবি উঠেছে।
কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসের উপপরিচালক এসএম খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, আমদানিকারক দেশগুলো কৃষিপণ্য নিতে গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস-জিএপি (গ্যাপ) অনুসরণের শর্ত দিচ্ছে। কন্ট্রাক্ট ফার্ম বা চুক্তিবদ্ধ কৃষকের কাছ থেকে ফল ও সবজি সংগ্রহ করে যথাযথভাবে মোড়কজাতের পর তা বিদেশে পাঠানোর জন্য দরকার আধুনিক প্যাকিং হাউস ও ল্যাবরেটরি। এটি পুরোদমে চালু হলে রপ্তানির বাজারে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে।
কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার সমকালকে বলেন, প্যাকিং হাউসের ল্যাব ও যন্ত্রপাতি বসানোর মতো মূল কাজগুলো এখনও শেষ হয়নি। প্রশিক্ষণ পাওয়া দক্ষ জনবল স্থায়ীভাবে রাখতে আমরা পদক্ষেপ নেব। সমন্বয় করে হলেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল রেখে ল্যাব সচল রাখা হবে।
সোর্স : সমকাল