ভিভিআইপি, ভিআাইপি এবং হোমরা-চোমরা ছাড়া সব শ্রেণির যাত্রীকে হজরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পোহাতে হয় নানান ভোগান্তি। কিছু কর্মকর্তার নির্দয় আচরণে সর্বস্তরের যাত্রীরা হচ্ছেন নাজেহাল। বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার কর্মী ও সরকারের সমালোচকদের হয়রানির অভিযোগ নতুন নয়। এই হয়রানি থেকে সংবাদপত্রের সম্পাদক, সাংবাদিক, বিশিষ্ট নাগরিক, এমনকি শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিদেশে কর্মরত বৈধ শ্রমিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না। স্বল্পশিক্ষিত যাত্রীদের নানা প্রশ্ন করে তাদের পাসপোর্ট আটকে রেখে টাকা আদায় এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এক শ্রেনির অসাধু ব্যবসায়ীর সাথে অবৈধ লেনদেনের চুক্তি থাকার কারণে বৈধ কাগজপত্র না থাকা পাসপোর্টধারী যাত্রীরা অনায়াসেই ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যান কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়াই।
ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, ইমিগ্রেশন পুলিশের কিছু কর্মকর্তার মনোভাব দেখে মনে হয়, তাদের টাকা দেয়ার জন্যই মানুষ বিদেশ যাচ্ছেন এবং দেশে ফিরছেন। বৈধ যাত্রীদের হয়রানি করা হলেও অবৈধ যাত্রীরা তাদের কাছে সম্মানিত। গলাকাটা পাসপোর্টে মানবপাচার হচ্ছে প্রতিদিনই এই ইমিগ্রেশন হয়েই। এসব যাত্রী বিদেশে গিয়ে কারাগারে আটকে থাকছেন। দেশে তারা ফেরত আসছেন নিঃস্ব হয়ে। এ ছাড়া ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে দেখার যেন কেউ নেই। এতে অনেক সময় ফ্লাইট শিডিউলও ঠিক রাখতে পারছে না সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সগুলো।
একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকার কর্মী ও সরকারের সমালোচক সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, তারা প্রায়শই বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হন।
বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, তাদের অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় নেতার বিমানবন্দরে অপেক্ষায় রাখা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিমান ছাড়ার প্রাক্কালে তাদের অনুমোদন মেলে বিমানে চড়ার। বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মাদ নুর খান বিমানবন্দরে একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তার যুক্তরাজ্য ও নেপাল সফরে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারের সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খানও একই ধরনের হয়রানির মুখোমুখী হয়েছেন। জাতিসংঘের তিন র্যাপোটিয়ার এক যৌথ ঠিচিতে আদিলুর রহমান খানের হয়রানির বিষয়টি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে জানিয়েছেন। সাধারণত সাদা পোশাকে আসা কোনো ব্যক্তি পরিচয় গোপন রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ইমিগ্রেশন ডেস্কে কর্মরত ব্যক্তিরা ‘উপরের নির্দেশে’ বিমান ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত বসিয়ে রাখেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে বিদেশের শ্রমবাজারে সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করে আসছেন প্রবাসীরা, সেখানে ইমিগ্রেশনের হাতে তাদের নিয়মিত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এমনিতেই বিদেশের শ্রমবাজার ছোট হয়ে আসছে। তবু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের নির্দয় আচরণ বন্ধ হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, দেশের তরুণরা বৈধ ভিসা নিয়ে পৃথিবীর যে কোনো দেশেই আবাস গড়তে যাত্রা শুরু করলেও বাড়তি না দিলে ইমিগ্রেশন আটকে দিচ্ছে। সন্দেহে আটক এসব মানুষের পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয় মালিবাগ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অফিসে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, ইমিগ্রেশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার ইনকিলাবকে বলেন, যাত্রী হয়রানির ঘটনা ঘটছে না, তা বলা যাবে না। তবে তা খুবই কম। প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩ হাজার যাত্রী হজরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছেন এবং সমপরিমান যাত্রী দেশে ফিরছেন। এ সময় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে আমরা তদন্ত করে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। এরপরেও হয়তো বিচ্ছিন্ন ভাবে হয়রানির ঘটনা ঘটে যেতে পারে। চুক্তি করে যাত্রী পাচারের ঘটনা ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সম্প্রতি ওমরা করে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, দীর্ঘ ভ্রমন শেষে শাহজালালে নেমে হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে আমাদের। আমাদের টিমে ছিল ৪৬ জন যাত্রী। ফ্লাইট অবতরনের পর বিমানবন্দরের ভেতরে আসার পর থেকেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ইমিগ্রেশনেও অনেক সময় লেগেছে। ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। মনিটর স্কিনে ঘোষনা দেয়া হয়-সউদী এয়ারলাইন্স থেকে আসা যাত্রীরা সাত নম্বর বেল্টে চলে যান। আপনাদের লাগেজ সেখানে পেয়ে যাবেন। ওই বেল্টে দাঁড়ানোর পর আধা ঘণ্টা পর আবারো ঘোষনা দেওয়া হয় ৮ নম্বর বেল্টে চলে যান। সেখানে আবার গেলাম আমরা। কিন্তু ওই বেল্টেও কাঙ্খিত লাগেজ আসছিল না।
সোহরাব হাসান নামে এক প্রবাসী জানান, জানুয়ারি মাসের শেষে তিনি দুবাই থেকে দেশে ফেরেন। ওই দেশে কোনো ধরনের নাজেহাল হইনি। অথচ আমাদের দেশেই এসে নাজেহাল হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার ফ্লাইট ছিল রাতের বেলায়। পরে কর্তৃপক্ষ দিনের বেলায় ফ্লাইট হবে বলে জানিয়ে দেয়। বিমান থেকে নেমে বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পাই মনে হয় কোনো বাজারে এসে পড়েছি। ইমিগ্রেশন কাউন্টারেই আসতে সময় লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা। অথচ দুবাইয়ে ৫ থেকে ১০ মিনিটের বেশি ইমিগ্রেশনে সময় লাগে না। এর আগে সহযোগিতার জন্য হেল্প ডেস্কে গিয়েছিলাম, প্রথমে কাউকে পেলাম না। পরে দু’জন নারী আসলেন। তাদের বললাম ফরম পূরণে সহায়তা করতে। তারা বললেন, ওই দিকে বুকিং কাউন্টারে যান। সেখানে গিয়ে দেখি দু’জন লোক ফরম পূরণ করে দিচ্ছেন, আর চুপিসারে টাকাও নিচ্ছেন।
ই-গেটের সুফল নেই, লাইনেই ঘণ্টা পার যাত্রীদের : সরেজমিনে শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হতে গিয়ে দেখা যায় যাদের ই-পাসপোর্ট আছে, তাদের অনেকেই ই-গেট ব্যবহার করছেন না। আবার যারা ব্যবহার করছেন, তাদের ভিসা যাচাইসহ অন্য কাজে ফের ইমিগ্রেশন ডেস্কে যেতে হচ্ছে। ফলে সময় লাগছে প্রায় আগের মতোই। এছাড়া কারিগরি ত্রুটির কারণে অনেক সময় ই-গেট বন্ধ থাকছে। তখন যাত্রী চাইলেও ই-গেট ব্যবহার করতে পারছেন না। তাই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েই সব যাত্রীকে সম্পন্ন করতে হচ্ছে ইমিগ্রেশন।
ই-পাসপোর্ট চালুর পর থেকেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ই-গেট স্থাপনের বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পরে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শাহজালালে স্থাপন করা হয় মোট ২৬টি ই-গেট। এর মধ্যে আগমনীতে ১২টি, বহির্গমনে ১২টি ও ভিআইপিতে দু’টি ই-গেট রয়েছে। যাদের ই-পাসপোর্ট রয়েছে, তারা এসব গেট ব্যবহার করে দ্রুত ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার কথা।
কিন্তু ই-পাসপোর্টধারী যাত্রীদের অভিযোগ, ই-গেট চালু হওয়ার আগে ও পরে-এর সুবিধা নিয়ে সরকার ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়েছে। বলা হয়েছে অল্প সময়ে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই যাত্রী ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। এখন দেখা যায় প্রায় সময়ই ই-গেট বন্ধ থাকে। যখন চালু থাকে, তখন অনেকেই এই গেট ব্যবহার বোঝেন না। ফলে যাত্রীরা এর সুফল পাচ্ছেন না। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষও এসব গেট ব্যবহারে যাত্রীদের উৎসাহ দিচ্ছে না।
তবে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ইমিগ্রেশন সংশ্লিষ্টরা জানান, তাদের সব ই-গেট সচল। দিনে দুই থেকে তিন হাজার ই-পাসপোর্টধারী যাত্রী এসব গেট ব্যবহার করছেন। এতে যাত্রীরাও সন্তুষ্ট। তবে কারিগরি কোনো কারণে হয়তো কিছু সময়ের জন্য ই-গেট বন্ধ থাকে। অন্যথায় সব সময়ই চালু থাকে ই-গেট। ই-পাসপোর্টধারীদের সহযোগিতা করতে প্রত্যেক গেটে লোক থাকেন বলেও জানান তারা।
ইমিগ্রেশন পুলিশের একাধিক সদস্য জানান, ই-গেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুধু পাসপোর্ট ও যাত্রীকে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাত্রীর ভিসা পরীক্ষা করা যায় না। এছাড়া যাত্রী কোথায় যাবে, কোন উড়োজাহাজে ভ্রমণ করবে, ই-গেটে সেই তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে ই-গেট ব্যবহার করলেও আগের মতোই ভিসা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে ম্যানুয়ালি। এতে ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। এর মধ্যে কাছাকাছি সময়ে একাধিক ফ্লাইট অবতরণ করলে বা গেলে ইমিগ্রেশনে আরও বেশি চাপ পড়ে। এই চাপ সামলাতে ইমিগ্রেশন পুলিশকেও হিমশিম খেতে হয়।
সোর্স : ইনকিলাব