দেশের বাজারে কোনভাবেই ডলারের সঙ্কট কাটছে না। সর্বত্রই ডলারের প্রভাব। আবার গত এক বছরে ডলার সঙ্কটে টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে দেশে খাদ্য, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ঘন ঘন বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ছোট ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে এবং কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যা দেশের রাজস্ব আয়েও প্রভাব ফেলবে। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঁধে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আয়ের অস্বাভাবিক লক্ষ্য। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি উন্নয়ন কাজ স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেটে ২০২২ সালের শুরুতে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা। বর্তমানে তা ১০৭ টাকায় উন্নীত হয়েছে। যদিও খোলাবাজারে আরও ৭-৮টাকা বেশি। যা মুদ্রাস্ফীতিকে ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে। এতে দেশের সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এদিকে ডলার সঙ্কটে চাল-গমসহ খাদ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক কমিয়েও আমদানি বাড়ানো যায়নি। আবার শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, চাল, সার, ছোলা ভোজ্যতেলসহ জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এর সঙ্গে সামনে হজের মৌসুম এ সময় আরও প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে হজ যাত্রীদের। এমনকি অতীব জরুরী হওয়া স্বত্তেও চাহিদা অনুযায়ী ব্লাড ব্যাগ আমদানি করতে পারছেন না আমদানিকারকরা। ফলে দেশের হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে ব্লাড ব্যাগের সঙ্কট। এতে দেশে রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমনকি ডলার সঙ্কটে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ওষুধ প্রস্তুতকারীরা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ওষুধ উৎপাদকরা ঠিক সময়ের মধ্যে ওষুধ রফতানি করার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। যা দেশের ওষুধ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে। পাশাপাশি অগ্রাধিকার খাতভুক্ত পণ্য আমদানি বন্ধ থাকায় সামনে দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিল্পের উৎপাদনও বন্ধের উপক্রম হবে। এমনকি এসব পণ্য আমদানিতে এলসিও কম খোলা হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে, এলসি খোলার পরও পণ্য দেশে আনার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের তেমন আগ্রহ নেই। এতে চাহিদার তুলনায় যোগান কমে যাওয়ায় হুহু করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এসব কিছুর প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোক্তাদের উপর। এমনিতেই আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি থাকায় নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পরিবারে। অবশ্য বর্তমান গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার গত বছরের জুলাইতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে নানামুখী উদ্যোগ নেন। এতে ডলারের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হলেও অন্যান্য সমস্যায় সঙ্কট আরও চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে আর্থিক খাতের অস্থিরতা অন্য খাতেও ছড়াতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও ডলার সঙ্কট কাটাতে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়িতে এলসি খোলার পরিমাণ কমলেও স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি ডলারের বাজার; বরং আগের চেয়ে আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। এদিকে বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চলমান অস্থিতিশীলতা মোকাবিলায় সহায়তায় গত ১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। আইএমএফ’র ঋণের কিস্তি পেয়েও স্থিতিশীল নয় রিজার্ভ। ঋণ পাওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে মোট ৩৩০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। গত বছরের ১ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ছেড়েছে, যা এ যাবতকালের রেকর্ড। আইএমএফ’র ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। অথচ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। যদিও আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছে, মুদ্রা বাজারে নিয়মিত ডলার না ছেড়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাড়তে। আর আইএমএফ’র শর্ত মানলে ডলারের দাম ১৩০ টাকায় পেঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর তখন এলসি করার সুযোগ দিলেও কোন লাভ হবে না।
এদিকে ডলারের তীব্র সঙ্কটের মধ্যেই আমদানি দায়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলোকে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির সংরক্ষিত নগদ অর্থের স্থিতি ছিল ৬৬৬ কোটি বা ৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এ স্থিতির পরিমাণ ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। প্রায় একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোয়ও। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির অর্থের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ অর্থের পরিমাণ কমে ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী ব্যাংক ও ব্যক্তির নগদ অর্থ কমেছে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে গত কয়েক মাস ধরেই ডলার সঙ্কট, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের বেশ কয়েকটি প্রধান শিল্প ও উৎপাদন খাতে। বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় ইতোমধ্যে সঙ্কটে পড়েছে ওষুধ শিল্প, সিমেন্ট খাত, হালকা প্রকৌশল শিল্প, চামড়া শিল্প এবং মুদ্রণ শিল্প ডলার সঙ্কটের কারণে গত বছরের মাঝামাঝি আমদানির ওপরে বেশকিছু কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকও আমদানিতে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে পারছে না।
তথ্য মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার সহায়তা নিয়ে সরকারি আমদানির জন্য জুলাই-ডিসেম্বর মাসে নিজেদের বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ ব্যয় করেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ২০২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এরমধ্যে খাদ্য, সার এবং জ্বালানি আমদানির জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে সরকারি পণ্য আমদানি হয়েছে ৮ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার, যা তাদের মোট আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশ।
এরফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন আমদানিকারকরা। কারণ আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি- বেশিরভাগ পণ্যই আমদানি করা হয়। এসব শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়েও জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন কারখানা মালিকরা। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে পরিবহন ও অন্যান্য খরচ। সম্প্রতি শিল্পে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর বেড়েছে কারখানায় উৎপাদন খরচ। এ কারণে সঙ্কটে পড়েছেন দেশীয় অনেক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। দেশীয় বাজারে একদিকে এসব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানি নিয়ে জটিলতায় উৎপাদন অব্যাহত রাখাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।
ইতোমধ্যেই ডলার সঙ্কটের প্রভাব এবারের হজ পালনকারীদের উপর পড়বে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। ডলার সঙ্কটে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রির আয় নিজ নিজ দেশে পাঠাতে পারছেন না। অনেক এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। ফ্লাইটের সংখ্যা হ্রাস অব্যাহত থাকলে যাত্রী পরিবহণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা চিনি ও ভোজ্যতেল বোঝাই জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি বলেই পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।
ডলার সঙ্কটের কারণে শিল্পের কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা না গেলে দেশের চলমান বহুমাত্রিক সঙ্কট আরও গভীর হবে বলে মত দিয়েছেন সিকম গ্রুপ ও প্রিমিয়ার সিমিন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক। তিনি বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন।
সূত্র মতে, দেশের বাজারে বর্তমানে চিনি সঙ্কট চলছে। কারণ আমদানি জটিলতা। বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান বলেন, চিনি আনার জন্য আমাদের প্রায় ২৭ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের এলসি করতে হয়। এলসি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি একটি নির্দেশনা আছে ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থের এলসি করা যাবে না। তাহলে আমাদের কী করার আছে?
শুধু কি চিনির দাম বাড়ছে? বাড়ছে আটা, ময়দা, চালের দামও। পরিস্থিতি সামাল দিতে এসব পণ্যের ওপর আরোপিত আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। তারপরও ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, কেউ কেউ বলছেন, যেসব পণ্য ১ হাজার টন থেকে ২ হাজার টন পর্যন্ত আনার অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যবসায়ীদের বাড়তি পরিবহন খরচ বহন করতে হচ্ছে। এতে তাদের তেমন একটা লাভ হচ্ছে না।
এছাড়া ডলার সঙ্কটে টিলেঢালা আমদানি-রফতানি ব্যবস্থায় বন্দর ফাঁকা পড়ে আছে। যদিও ডলার সঙ্কটে আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় দিনের পর দিন সাগরে ভাসছে পণ্যভর্তি জাহাজ। সাগরে এভাবে পণ্য ভাসার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
শুধু চিনির দামই বাড়ছে না; ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। প্রতিবছর এই খাতে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানি সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না। এমনকি হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্জিন দেয়ার পরেও এলসি খোলা যাচ্ছে না। আবার অনেক আমদানিকারক হয়তো কাঁচামাল এনেছেন, কিন্তু বন্দর থেকে সময়মতো খালাস করতে পারছে না। কারণ ব্যাংক এলসি নিষ্পত্তি করতে পারে না। ফলে অনেক কারখানায় ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারণে ওষুধ উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাবে ওষুধের দাম বাড়ছে।
ওষুধের মতোই প্রভাব পড়েছে দেশের আরেকটি বড় শিল্পখাত সিমেন্ট শিল্পে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ডলারের বাড়তি দামের কারণে তাদের ঋণের খরচ ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে চলতি মূলধন সঙ্কটে পড়েছে সিমেন্ট শিল্প।
এদিকে বাংলাদেশে গাড়ির ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে কৃষি ও নির্মাণ কাজের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ, নাট-বল্টু, বেয়ারিং ইত্যাদি অনেক এখন দেশেই তৈরি করা হয়। কিন্তু কাঁচামালের দাম হুহু করে বাড়তে থাকায় এবং ডলারের দাম বাড়ায় যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। এতে এসব যন্ত্রাংশের বিক্রিও কমে গেছে।
অপরদিকে চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই খাতের চামড়া দেশের ভেতর থেকে সংগ্রহ করা হলেও, প্রক্রিয়া করার জন্য দরকারি রাসায়নিক বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আরো অনেক খাতের মতো ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদেরকেও। এছাড়া ডলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বইয়ের দাম বাড়ায় মুদ্রণ শিল্প সংশ্লিষ্টরা বিপাকে।
সূত্র জানায়, বেসরকারি আমদানি প্রায় বন্ধই রয়েছে। আমদানি যা হচ্ছে তার ৮০ শতাংশই সরকারিভাবে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক গত ছয় মাসে ২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার ইম্পোর্ট এলসি খুলেছে। এরমধ্যে সরকারি আমদানির পরিমাণই ছিল ২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। যা তাদের মোট আমদানির ৯৪ শতাংশ। এছাড়া এই সময়ে বেসরকারি আমদানি ছিল মাত্র ১৬১ মিলিয়ন ডলার। একইভাবে, ২০২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মোট আমদানির মধ্যে অগ্রণী, জনতা এবং রূপালীর সরকারি আমদানি ছিল যথাক্রমে ৬৮ শতাংশ, ৭৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং ৮০ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলেন, দেশের ডলারের সঙ্কটের কারণে রিজার্ভ কমতে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি বন্ধ রেখেছে। এখন যা ডলার বিক্রি করছে সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছেই। এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রির পূর্বে কোন এলসি বাবদ ডলার ছাড় করবে তা যাচাই-বাচাই করে দিচ্ছে। তা যদি সরকারি আমদানি হয় অথবা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হয় তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার দিচ্ছে। যার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আমদানির পরিমাণ বেশি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, সরকারি আমদানির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের ডলার সরবরাহ করে থাকে। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে সরকারি আমদানিকে বেশি অগ্রধিকার দিচ্ছি। সরকারি আমদানিতে সাধারণত চাল, গম, সার এবং পেট্রোলিয়াম অন্তর্ভুক্ত থাকে। অথচ প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে, ২০২২ অর্থবছরে সবচেয়ে বড় খাদ্য আমদানিকারক ছিল দেশের বেসরকারি খাত; চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেও একই চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু, বর্তমানে এলসি খোলার পরিমাণ কমে আসায় রমজানের আগে খাদ্যদ্রব্যের আমদানি নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ী ও বেসরকারি আমদানিকারকরা।
এদিকে ডলার সরবরাহে লাগাম টানার ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এলসি খুলতে পারছেনা বলে জানিয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে খাদ্যসহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহের বিষয়ে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিবর্তে, বেসরকারি ঋণদাতাদেরকে নিজস্ব উৎস থেকে ডলার সংগ্রহ করে আমদানির খরচ মেটাতে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার ফলে জুলাই-ডিসেম্বর মাসে সামগ্রিক আমদানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। আর তাই একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার পরিমাণ খুবই কম। কারণ তারা এই সময়ে এলসি খোলার চেয়ে ডলার সংগ্রহে বেশি নজর দিচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের তুলনায় আমদানিতে ব্যয় বেশি হচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ডলারের সঙ্কট আমরা যা দেখছি বাস্তবে তার চেয়ে আরো গভীরতর। প্রকৃত পক্ষে আমাদের ডলার কী পরিমাণ আছে, ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদার বিপরীতে কী পরিমাণ পাচ্ছে তা নিয়মিত সপ্তাহভিত্তিতে তদারকি করা দরকার। একই সঙ্গে এখন আমাদের দরকার অর্থনীতিতে ভারসাম্য রেখে প্রয়োজনের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, সেভাবে এলসি খুলতে দেয়া।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজারে আমদানি করা পণ্যের ঘাটতি শুরু হয়েছে। গমের দাম বেশি, কারণ, ডলার সঙ্কটে গম আমদানি করা যাচ্ছে না। চিনির দাম বেশি, কারণ, চিনি আমদানি করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দাম আরো বাড়বে। তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার টাকার সংস্থান বাড়াতে পারবে। কিন্তু ডলার তো বাড়াতে পারবে না। টাকা তো ডলার না।
সোর্স : ইনকিলাব