দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সাথে পুঁজিবাজারের কোনো মিল নেই। অর্থনীতির বেশ কিছু সূচক ইতিবাচক থাকলেও শেয়ারবাজারে সঙ্কট কোনো ভাবেই কাটছে না। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে রক্তক্ষরণে নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। নি¤œমুখী শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিক সময়ে বাজার থেকে শিল্পায়নের জন্য পুঁজি সংগ্রহ যেকোনো সময়ের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।
শেয়ারবাজারের আড়ালে বাজার থেকে দুষ্টচক্রের পকেট ভারী হয়েছে। আর সঙ্কটের কথা বলে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বেশ কিছু সুবিধা নিয়েছে বাজারসংশ্লিষ্টরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বাড়তি কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আস্থা সঙ্কট না কাটলে বাজার ইতিবাচক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
তিনি বলেন, বাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে প্রণোদনার কথা আসছে। কিন্তু প্রণোদনা দিলে বাজার সাময়িকভাবে উপকৃত হয়। এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। তার মতে, দেশের শেয়ারবাজার অবমূল্যায়িত। কিন্তু বিনিয়োগ হুজুগে মাতে। এতে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজার অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ফলে প্রণোদনার পরিবর্তে এখানে আইন কানুন সংস্কার জরুরি। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির অন্যসব সূচক এগিয়ে গেলেও শেয়ারবাজার পিছিয়েছে।
বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায় বর্তমানে শেয়ারবাজারে প্রধান উদ্বেগ ‘লেনদেন’। হঠাৎ করে বাজারের লেনদেন অনেক কমে গেছে। এ কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারী সবার মাঝেই ছড়িয়েছে উদ্বেগ। লেনদেন কমে যাওয়ায় সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন লেনদেন কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। লেনদেন বাড়িয়ে শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে এক দিন লেনদেন বাড়ে তো আরেক দিন কমে।
তারা আরো বলছেন, শেয়ারবাজারে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তখনই শেয়ার কেনেন, যখন তার হাতে কেনার মতো অর্থ থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ভালো ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করে অনেকে আটকে গেছে। ফলে তাদের বিনিয়োগসক্ষমতা অনেক কমে গেছে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা আস্থা সঙ্কটে ভুগছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আস্থা ফেরানো নিয়ন্ত্রক সংস্থার বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বাজার একটানা দরপতন হতে হতে শেয়ারের দামগুলো তলানিতে চলে এসেছে। এ অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিকসহ বড় বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। ফলে গতিহীন অবস্থায় রয়েছে।
এম সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আবুল কাশেম বলেন, পুঁজিবাজারের প্রতি এখন আর আস্থা নেই। টানা বছরের পর বছর বাজার পতন হলেও এর কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখছি না। যতবার শেয়ার কিনছি। যতবার শেয়ার এভারেজের চেষ্টা করছি, ততবার লোকসানের মুখে পড়ছি। ফ্লোর প্রাইসে। ফলে এসব শেয়ারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আটকে গেছে। এ ক্ষেত্রে বেশি বিপদে পড়েছেন ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। যারা ঋণ নিয়ে ভালো ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের অনেকে এখন এসব শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে তাদের শেয়ার লেনদেন না করেও গুনতে হচ্ছে ঋণের সুদ।
বাজারের গতি কমে যাওয়ায় এবং বেশির ভাগ শেয়ার সর্বনিম্ন মূল্যস্তরে নেমে আসায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এখন ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ারও সাহস করছে না। সংস্থাটির শঙ্কা, তাতে বাজার আরো পড়ে যেতে পারে। অন্য দিকে ফ্লোর প্রাইসের কারণে নতুন বিনিয়োগও বাজারে আসছে না। ফলে বাজারে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। লেনদেন নেমেছে তলানিতে।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, যদি সব কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসে, তখন লেনদেন আরো কমে যেতে পারে। তখন বাজারে এক ধরনের স্থিতাবস্থা নেমে আসবে।
বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, ভালো ভালো অনেক কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসায় অনেকের বিনিয়োগ আটকে গেছে। আবার নতুন করে যারা বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা করছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে তারাও বিনিয়োগে সাহস করছেন না। শেয়ার কিনে যদি বিক্রি করা না যায়, তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বাড়ে। যার প্রভাব পড়ে বাজারে।
তিনি বলেন, ‘কৃত্রিমভাবে বাজার ধরে রাখতে গিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে লেনদেন কমে গেছে। অতীতেও আমরা দেখেছি কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম ও বাজার কোনোটিই শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যায় না। বাজারকে বাজারের নিয়মেই চলতে দিতে হয়। তাতে দাম কমে গেলেও কম দাম দেখে অনেক বিনিয়োগকারী নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্চেন্ট ব্যাংকের এক শীর্ষ নির্বাহী বলেন, বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানিসহ ভালো মৌলভিত্তির কিছু শেয়ারে দুই মাস ধরে তাদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে গেছে। এসব কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকায় লেনদেনও করতে পারছে না। ফলে তাদের প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের পরিমাণও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কমে গেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, বাজারে গতি কমে যাওয়ায় এবং পতনের ধারায় থাকায় এখনই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার মতো বাস্তবতাও নেই। তাই ফ্লোর প্রাইস না তুলে বাজারে কিভাবে লেনদেন বাড়ানো যায়, সেই পথ খুঁজছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পাশাপাশি বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতেও নানামুখী চেষ্টা চলছে।
এ দিকে পুরনোদের বাদ দিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদে চারজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের স্বাক্ষরিত এক চিঠি ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
আগামী তিন বছরের জন্য তদন্ত পরিচালক হিসেবে বোর্ডের চারজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনটি ক্যাটাগরিতে আরো দু’জনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে।
নতুন চার পরিচালক হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তি অনুষদের ডিন ড. হাফিজ হাসান বাবু, ব্যাংকিং এবং বীমা বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন ও ওরাকল বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (নেপাল ও ভুটান) রুবাবা দৌলা।
সোর্স : নয়া দিগন্ত