ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা বাড়ছে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী গ্রুপের মধ্যে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণ নেয়া হচ্ছে। বিপরীতে মুনাফাও পরিশোধ করা হয় না এমন অভিযোগও উঠেছে ওইসব ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে। বছরের পর বছর ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকিং খাতে বেড়ে যাচ্ছে মন্দ ঋণ। ডিসেম্বর শেষে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকাই আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৯ শতাংশ। আর এ মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো প্রায় অর্ধলাখ কোটি টাকার মুনাফা আয় খাতে নিতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, এসব মুনাফা স্থগিত করে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে কখনো কিছু আদায় হলে তার বিপরীত অর্জিত মুনাফা আয় খাতে নেয়া যাবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এর ফলে ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররাই বঞ্চিত হচ্ছেন না, ব্যাংক ঋণের গুণগত মানও কমে যাচ্ছে। আর এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির মাত্রা। অপর দিকে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের নতুন বিনিয়োগ সক্ষমতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুই বছর আগেও অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরে ৮৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩৬ হাজার কোটি টাকার মুনাফা স্থগিত রাখা হয়েছিল। দুই বছর পরে মুনাফা স্থগিতের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত ২০২১ সাল শেষেও এর পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সম্পদ থাকলেও ১৫ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। আগে সম্পদ থাকলে কোনো প্রভিশন রাখতে হতো না। আবার মন্দ ঋণ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসেবে ধরা হয়। আর এ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর জরিমানা গুণতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিরস্কার বা জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো আয় খাত থেকে টাকা এনে প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করে থাকে। পাশাপাশি, মন্দ ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলোর আয় খাতে স্থানান্তর করা হয় না। অর্জিত সুদ ব্যাংকের আলাদা হিসেবে স্থগিত করে রাখা হয়। কখনো কোনো ঋণ আদায় হলে তার বিপরীতে অর্জিত মুনাফা আয় খাতে তখন নেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকার মন্দ ঋণের মধ্যে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরই অর্ধেক অর্থাৎ ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা। আর এ মন্দ ঋণের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মুনাফা স্থগিত করে রেখেছে ২২ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা।
মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিগত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকগুলোতে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, এনন টেক্স, থার্মেক্স, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিসহ বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। এসব ঋণ দীর্ঘ দিন যাবৎ অনাদায়ী রয়েছে। মূলত ঋণকেলেঙ্কারি বেড়ে যাওয়াই মন্দঋণ বেড়ে গেছে। মন্দঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক অদালতে মামলা করে থাকে। কিন্তু আইনগত জটিলতায় তা বছরের পর বছর অনাদায়ী থাকে। কেননা, এসব ঋণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বিতরণ করা হয়। আর এক্ষেত্রে ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেয়া হয় না।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক আলোচ্য সময়ে সুদ স্থগিত করেছে ২৩ হাাজর ৫০৩ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৫৬ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৪৭ হাজার ২৪ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। এ সময়ে বিদেশী ব্যাংকগুলো সুদ স্থগিত করেছে ৪১২ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিযেছেন, প্রকৃত হিসাবে খেলাপি ঋণ আরো অনেক বেশি। তবে কিছু কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করছেন না। আবার এসব ঋণ নানাভাবে খেলাপি হিসেবেও দেখানো হচ্ছে না। বিশেষ পদ্ধতিতে নিয়মিত রাখা হচ্ছে। আবার এসব ঋণের বিপরীতে মুনাফাও পরিশোধ করা হচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। আর এ কারণে কিছু ব্যাংক সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণ করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। সঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তারা হাত পাতছে। নীতি সহায়তা দিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে শক্ত অবস্থান নিলে একদিকে সাধারণ আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকির মুখে পড়ত না, পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের ভিত্তিও আরো শক্তিশালী হতো।
তারা জানিয়েছেন, মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর নিট আয় কমে গেছে। শুধু ব্যাংকগুলোর নিট লোকসানই বাড়েনি, ব্যাংকগুলোর ইতোমধ্যে মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে। পাশাপাশি সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা বছর শেষে প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সোর্স : নয়া দিগন্ত