আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত যেভাবে চাল, ডাল, তেল, নুন, মরিচের দাম বেড়ে চলেছে তাতে ধনীর চুলা না নিভলেও মধ্যবিত্ত এবং গরিবের চুলা যে নিভে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণ ক্ষুব্ধ কিন্তু আওয়াজ করে বলার ক্ষমতা নেই। নি¤œ ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ এখন বোবাকান্না করছে। এই বোবাকান্নার আওয়াজ সরকার, আড়ৎদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, সিন্ডিকেট কারো কর্ণকুহরেই পৌঁছায় না। এমনকি সবজি, মুরগি ও মুরগির ডিমের দামও সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমা অতিক্রম করেছে। খুচরা বিক্রেতারা বলেন, আড়ৎদাররা সিন্ডিকেট করে পণ্য মজুদ করার কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বাজারের এই অস্থিরতার দায় কেউ নিতে রাজি নয়।
আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মানুষের ভেতরেই অসৎ উপায়ে স্বল্পসময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা জেঁকে বসেছে। আবার ধনী কোম্পানিগুলোও সব রকমের ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করছে। অনেক বড় কোম্পানিও মুড়ির ব্যবসায় নেমে পড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের বাজার যখন ধনী কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে তখন ছোট কোম্পানিগুলো মার খেয়ে যাচ্ছে এবং তারা বেকার হয়ে পড়ছে। সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে গিয়ে এর মারাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য বহু বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলোর দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে পাগলা ঘোড়ার দৌড়ের গতিতে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে কয়দিন পরপর। ফলে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের শান্তির নিদ্রা হারাম হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে সিন্ডিকেট তৈরি করে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধিতে সিদ্ধহস্ত মজুদদার, মুনাফাখোর, চোরাচালানি, অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। কোনো আইন তাদের স্পর্শ করতে পারে না। সরকারের হোমরা-চোমরাদের সাথে সম্পর্ক রেখেই এই অসাধু ব্যবসায়ীর দল সুযোগ বুঝে হঠাৎ পণ্য গুদামে মজুদ করার মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে। পণ্যের জন্য চাহিদা বৃদ্ধি পেলে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে এবং অল্প অল্প করে মজুদ পণ্য বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। এই সময়ে চোরাকারবারিরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় দেশী পণ্য বিদেশে পাচার করে দিলে বাজারে পণ্যের সঙ্কট সৃষ্টি হয়। কালো টাকার প্রভাবে সমাজের এক শ্রেণীর লোকের পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের তুলনায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। একটি অস্বাভাবিক সরকারের আমলে সরকারি দলের চুনোপুটি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অস্বাভাবিক গতিতে ধনী বনে যায়। আর ওই সরকারের পিয়ন-চাপরাশি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত সবাই সমানতালে দুর্নীতির মহাসড়কে চলে আসে। কাজেই কোনো কিছুই তাদের জীবন চলার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু সাধারণ জনগণের ওপর চলে স্টিম রোলার। নিষ্পেষিত জনগণের বোবাকান্না করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
মধ্যবিত্ত ও নি¤œ আয়ের মানুষদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায়ও ভাটা পড়ছে। খাতা-কলম, বই-পুস্তক অর্থাৎ- শিক্ষাসামগ্রীর দামও আকাশচুম্বী। একজন দরিদ্র পিতার পরিবারের সদস্যদের খাবার কিনতে যেখানে জান শেষ হয়ে যাচ্ছে সেখানে ছেলেমেয়েদের জন্য খাতা-কলম, বই-পুস্তক কিনবে কোত্থেকে। কোনো কোনো সংসারে এক বেলা খাবার জুটলেও জুটছে না কয়েক বেলা। তাদের চোখে-মুখে নিরাশার কালো মেঘ জমাট বাঁধছে। বাঁচা-মরা দুটোই তাদের কাছে সমান মনে হয়। সন্তানদের কাছে পিতার অসহায় মুখ লুকিয়ে আর মিথ্যা আশ^াসে চলতে হয় দিনের পর দিন। এটিই হলো বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিবিত্ত পরিবারের বাস্তব দৃশ্য।
বাংলাদেশের বর্তমান বাজার ব্যবস্থাপনায় ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে আর দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছে। সমাজের এই বৈষম্য আইন-আদালত, বিচার-সালিশ, থানা-পুলিশ, প্রশাসনিক সেক্টরেও বিরাজমান। আইন-আদালত ধনীদের স্পর্শ করতে না পারলেও দরিদ্রদের ওপর চলে এর নির্মম প্রয়োগ। হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিদের বিচার না হলেও ব্যাংক থেকে সামান্য টাকা ঋণ তুলে পরিশোধ করতে না পারলেই গরিবের কোমরে দড়ি আর হাতে হ্যান্ডকাফ পরে। ব্যাংকের টাকা লুট করে বিদেশের মাটিতে রাজপ্রাসাদ তৈরি করলেও তাদের বিচার হওয়ার দৃষ্টান্ত কম। কিন্তু একজন কৃষক কৃষিঋণ নিয়ে ফসল ভালো না হলে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলেই আর যায় কোথায়! ব্যাংকের থানায় যেতেও সময় লাগে না; আর পুলিশকেও আসামি ধরতে বেগ পেতে হয় না। তাই বলছি, শুধু দ্রব্যমূল্যের আস্বাভাবিক বৃদ্ধিই জনগণের জন্য দুঃস্বপ্ন নয়; বরং সব জায়গায় সাধারণ জনগণের ভোগান্তির করুণ দৃশ্যের সাক্ষী হতে হয়। তাদের জন্য বিচার চাওয়ার জায়গা যেমন সঙ্কুচিত, বিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছে। আবার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যাংকঋণ জালিয়াতি ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রের টাকা বিদেশে পাচার করার কারণে আজকের এই দুরবস্থা। সরকার কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছে না। সরকারের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা নিজেরা যেমন দুর্নীতির মহাসড়কে আছে তেমনি সরকারি সিদ্ধান্ত যারা বাস্তবায়ন করে তারাও বসে নেই। রাষ্ট্রের জনগণকে এই ত্রাহি অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার। অর্থাৎ জনসমর্থনবিহীন সরকার যারা প্রশাসনিক শক্তির ওপর ভর করে জনগণের ওপর স্টিম রোলার চালাচ্ছে তাদের পরিবর্তন দরকার।
রাজপথের বিরোধী দলগুলো তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজপথে আন্দোলন করে যাচ্ছে। বিএনপি উপরিউক্ত বিষয় ও ১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পদযাত্রার মতো শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছে। আর এই আন্দোলনগুলোতে সব শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণ করছে। প্রতিটি সমাবেশে লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি প্রমাণ করছে জনগণ সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট। কিন্তু সরকার জনগণের এই দাবিকে নিয়ে মশকরা করছে। মন্ত্রীদের কেউ বলছেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কী হবে- মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আবার কেউ বলছেন, মানুষ না খেয়ে নেই। তারা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। মন্ত্রীদের এ সমস্ত কথা জনগণের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সিন্ডিকেট করে কৃত্রিমভাবে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে, তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা সরকার হারিয়ে ফেলেছে। তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারায় পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ডলার সঙ্কটের কারণে এলসি বন্ধ হয়ে আছে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। কিন্তু সরকার মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম না কমিয়ে গরিবকে মারছে, অন্য দিকে মেগা প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের ব্যবস্থা করছে। কেউ এর প্রতিবাদ করলে, সরকার হুমকি দিয়ে বলছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ভর্তুকি বন্ধ করে দেবো।’
জনগণের দাবি নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে লাখ লাখ লোক হাজির হলেও সরকারের চোখে তা নেহায়েত কম। সরকার বলতে চাচ্ছে, জনগণ বিরোধী দলের দাবির সাথে একমত না। সরকারের উচিত বিরোধী দলের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না গুনে জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের ব্যবস্থা নেয়া। না নিলে জনগণের দাবি জনগণই আদায় করে নেবে। জনগণ জানে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি একটি অতি স্বাভাবিক প্রবণতা। জনগণ এটিও মানে, এখন শায়েস্তা খানের আমল নয়। সময়ের সাথে সাথে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়- এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে দাম বৃদ্ধির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা মঙ্গলজনক। আজকের বাস্তবতা হলো- মূল্যস্ফীতি বাড়ছে কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। মোদ্দা কথা, জনগণকে এই ত্রাহি অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে হলে সরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছার প্রয়োজন। প্রয়োজন অবৈধ সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা ও তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া।
harun_980@yahoo.com
সোর্স : নয়া দিগন্ত