খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ৩৬টি। এরমধ্যে অধিকাংশ ইটভাটায় ১০-১২ বছরের তিন শতাধিক শিশুদের দিয়ে প্রতিনিয়ত ইট ভাঙা ও ইটখোলায় ইট আনা-নেয়ার কাজ করানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন, কারখানা আইন ও শিশু আইনে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ হলেও তা এখনও কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।
ইটভাটায় নিয়জিত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মূলত দারিদ্র্যের তাড়নায় এসব শিশুর বাবা-মা তাদের ইটভাটার কাজে পাঠিয়েছে। ইটখোলায় প্রতিবার আনুমানিক ২০ কেজি ওজনের নূন্যতম ৬টি করে ইট আনা-নেয়া করতে হয় এসব শিশুকে। অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ওজনের চাপে বিভিন্ন দুর্ঘটনারও শিকার হচ্ছে তারা। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় তাদের জীবনযুদ্ধ। কিন্তু পরিবার কিংবা মাঝি (ইটভাটার ইট আনা-নেয়ার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি) কেউই বুঝতে রাজি নয় যে, এসব শিশুর এখন স্কুলে থাকার কথা। অনেক ক্ষেত্রে এসব শিশুর ন্যায্য পাওনা থেকেও বঞ্চিত করা হয়। এ ছাড়া কাজে বিঘ্ন ঘটলে নিয়মিতভাবেই মালিকপক্ষের মারধর ও ধমকের শিকার হতে হয়।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রতিরোধ ও নিরসনবিষয়ক আইএলও কনভেনশন সমর্থনকারী দেশ। শিশুদের কায়িক শ্রম বন্ধে জাতীয় শিশুশ্রম নীতি ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও দেশের লাখ লাখ শিশু কায়িক ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শিশুশ্রম সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। আইএলও কনভেনশনে বলা হয়েছে- ১৮ বছরের কম বয়সী এবং শ্রমে নিয়োজিত হওয়ার ন্যূনতম বয়সের ঊর্ধ্বে যেসব শিশু অবস্থান করছে, তাদের বাধ্যতামূলক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে অথবা আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশুকে চাকরি করার অনুমতি দিলে তিনি ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অথচ আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছেন নিয়োগদাতারা।
এ ব্যাপারে দীঘিনালার ফোরস্টার ইটভাটার মালিক নুর হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিশুরা কাজ করছে- এটা আমাদের বিষয় নয়। এটা মাঝির বিষয়। মাঝি আবুল কালাম মৌসুমের শুরুতে আমার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে গেছে। এখন সে হিসেবেই তারা আমার ইট তৈরি করে দেয়।
এছাড়া কেবিএমের ম্যানেজার জাহাঙ্গীর হোসেন, এডিবির মালিক মো. নাসির ও এসএন্ডবির ম্যানেজার মাসুদ রানাসহ অধিকাংশ ইটভাটা মালিক ও ম্যানেজাররা একই কথা বলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাঝি আবুল কালাম জানান, ভাটায় নিয়জিত শ্রমিকরা চর এলাকা থেকে এসেছে। এটা খুবই অভাবী এলাকা। আর ছোট বাচ্চারা এখানে তাদের বাবাদের সাহায্য করতে আসে। হয়তো তিনবেলা পেট ভরে খাবার পায় বলেই এখানে চলে আসে।
সরেজমিনে খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা ও দীঘিনালার অধিকাংশ ইটভাটায় দেখা যায়, ৮-১২ বছরের শিশুদের দিয়েই কাজ করানো হচ্ছে। দীঘিনালা উপজেলার ফোরস্টার ইটভাটায় কাজ করতে আসা ৯ বছর বয়সী শিশু মামুন (ছদ্মনাম) বাবার সঙ্গে এখানেই কাজ করে। মামুনের বাবা বলেন, অভাবের তাড়নায় যেখানে পরিবার নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকাই দায়, সেখানে শিশুর শিক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে ভাবার সুযোগ কই? ইটভাটায় কাজ করে আল্লাহর রহমতে দু-একবেলা খেতে পারছি- সেটাই বড় কথা।
একই ইটভাটায় নোয়াখালী থেকে আসা ১০ ও ১২ বছর বয়সী রহিম ও করিম (ছদ্মনাম) বলেন, আমরা দুইভাই ৭৫ হাজার টাকায় ৬ মাসের জন্য মাঝির কাছে বিক্রি হয়েছি। অভাবের কারণেই এখানে আসা।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন দীঘিনালা উপজেলা শাখার সভাপতি মো. আবদুর রহমান বলেন, ইটভাটায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এ আইন মানার বালাই নেই। শিশুরা যে বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে আসছে এখানে কাজ করতে।
খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ছাবের বলেন, ইটভাটায় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালুতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিসের মতো শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া অতিরিক্ত পরিশ্রমে রক্তস্বল্পতা, দুর্বলতার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।
ইটভাটায় শিশুশ্রমের বিষয়ে সম্প্রতি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান এক বক্তব্যে বলেন, শুধু ইটভাটাই নয় সর্বক্ষেত্রে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। কেউ শিশুদের দিয়ে কাজ করালে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সোর্স : ইনকিলাব