স্টাফ রিপোর্টার: জ্বালানি তেল আর গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে বিদ্যুতের উৎপাদন কমেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লেও আসছে গরমে বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত গ্রাহকরা। একই সাথে শিল্প খাতে উৎপাদনও কমবে। শীতে সাময়িক স্বস্তি দিলেও ফের লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হচ্ছে দেশ। আসন্ন গ্রীষ্মে সাড়ে চার কোটি গ্রাহক পুড়বে লোডশেডিংয়ের তাপে। দেশের শহরাঞ্চলে গরম পড়া শুরু হলেও গ্রামাঞ্চলে শীত কিছুটা রয়ে গেছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে লোডশেডিং। তীব্র গরমে তা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা নিয়ে গ্রাহক এবং ব্যবসায়ীদের শঙ্কা।
আসছে মার্চ মাস থেকে বিদ্যুতের সংকট আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। এক সময় ভুলতে বসা লোডশেডিং গত বছরের জুলাই মাসে ঘোষণা দিয়ে ফিরে আসে। সে সময় বলা হয়েছে, অক্টোবর নাগাদ শীত এলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হয়। শীতের ভরা মৌসুমেই এবার সাক্ষাৎ লোডশেডিংয়ের। শীত মৌসুমে বিদ্যুতের গড় চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট কিন্তু উৎপাদন ৯ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। বাকিটা লোডশেডিং করতে হয়। শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম হলেও তা সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়লা সংকটে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট, বিশ্ববাজারে জ্বালানি দাম বৃদ্ধি, দেশে ডলার সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার মান হ্রাসসহ নানা কারণে সরকার গত বছর থেকেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি বন্ধ করেছে। এর পর থেকে তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে পুরো দেশ। শীতের প্রভাবে নবেম্বর থেকে চাহিদা কমতে থাকে বিদ্যুতের। ফলে নবেম্বর এবং ডিসেম্বরে লোডশেডিং তেমন একটা দেখা যায়নি। সাময়িক স্বস্তির পর জানুয়ারির শুরু থেকে আবারও লোডশেডিং দেখা দেয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছর জুলাইয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ঘোষণা দেয় সরকার। তখন দেশে উৎপাদন কমেছে অর্ধেকের কম। বহু শ্রমিক কর্ম হারিয়েছে। সামনের গ্রীষ্মে কি দশা হবে তা আল্লাহই ভালো জানে বলে মন্তব্য করেন এক ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা। সম্ভাব্য লোডশেডিংয়ে শঙ্কিত ক্ষুদ্র-মাঝারি-বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি সাশ্রয় করার জন্যই কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। আপাতত এই লোডশেডিং মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। চলতি শীতের মৌসুমেও দেখা দিয়েছে লোডশেডিং। বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণ সবই ঠিক আছে, কোথাও কোনো দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তবুও প্রতিদিন গ্রাম-শহর সবখানে লোডশেডিং হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের বিতরণ ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা নেই। সংকট যা কিছু সব উৎপাদনে। ইতোমধ্যে সরকার দুই দফায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না দিয়ে দাম বাড়নোতে অসন্তোষ গ্রাহকের। বিতরণ কোম্পানি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) বলছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি তারা ৮৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে। একই দিন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দুপুর ২টার দিকে ৪১৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে। এদিন বিকাল ৪টায় সারা দেশে আরইবির লোডশেডিং ছিল ৪৫০ মেগাওয়াট। এভাবে দিন-রাতের যখনই উৎপাদন কম হচ্ছে, তখনই লোডশেডিং করতে বলা হচ্ছে। সাধারণত শীতে বড় কোনো বিপর্যয় ছাড়া লোডশেডিং করা হয় না। সেখানে এবার শীত গ্রাহকের জন্য খানিকটা বিদ্যুৎ বিড়ম্বনা বয়ে এনেছে।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, দিনের বেলা ১২টার দিকে লোডশেডিং করতে বলা হয় ২০০ মেগাওয়াট। বিকালে তা তুলে নিতে বলা হয়। রাতে আবার লোডশেডিং হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তো বলতে পারছি না। উৎপাদন কম হচ্ছে তাই লোডশেডিং হচ্ছে। রাজধানীর বাইরে প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং থাকছে এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয়রা। চট্টগ্রামের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে এই লোডশেডিং। বিশেষ করে সন্ধ্যায় ঘরে যখন আলোর দরকার হয় তখন থেকেই শুরু হয় লোডশেডিং। চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত। এতে আসন্ন এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পড়ালেখার প্রস্তুতিতে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে নগরীর ঘরে ঘরে মশাসহ নানা রকম পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে গেছে। সন্ধ্যার পর থেকে লোডশেডিংয়ের কারণে নগরীর হোটেলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অন্ধকারে ডুবে থাকছে।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হেদায়ত উল্লাহ বলেন, আমার এক মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। এপ্রিলের শেষ নাগাদ পরীক্ষা শুরু হতে পারে। সে হিসাবে হাতে ৩ মাসের মতো সময় আছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পড়ালেখার প্রস্তুতি নিতে পারছে না। তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হয়। একবার গেলে আসে এক ঘণ্টা পর, আসলে কখনো কখনো এমন হয় যে দুই মিনিটও বিদ্যুৎ থাকে না। এভাবে রাত দেড়টা পর্যন্ত বিদ্যুতের লোডশেডিং চলে। শুনেছি ঢাকায় মেট্রোরেলের ইঞ্জিনে বৈদ্যুতিক চার্জ দিতে এই লোডশেডিং করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখন তেল আমদানি কমে গেছে। ফুয়েলের অ্যাবিলিটি থাকলে সমস্যা হবে না। তাই গ্রীষ্মকালে যথাযথ বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকবে কি-না তা এখন বলা সম্ভব নয়। এর মধ্যে অবশ্য আমদানি থেকে আমরা বিদ্যুৎ পাব। কবে নাগাদ পাওয়া যাবে জানতে চাইলে বলেন, আগামী ২৬ মার্চ থেকে আমদানি বিদ্যুৎ দেয়ার কথা রয়েছে। এখন বিদ্যুৎ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে শুরুর দিকে হওয়ায় তা নিয়মিত নয়। আগামী ২৬ মার্চ থেকে নিয়মিত বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। তারা শুরুর দিকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিলেও পরবর্তী সময়ে এক হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। তবে চাহিদা অনুযায়ী এটি কতটুকু পূরণ করবে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হয়েছিল, নবেম্বরের পর শীত শুরু হলে আর লোডশেডিং হবে না। কারণ শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ সেই অবস্থান থেকে সরে এসে এখনও নিয়মিত লোডশেডিং দিয়ে যাচ্ছে। দেশে মোট বিদ্যুতের প্রায় ৮৫ শতাংশই উৎপাদন করা হয় গ্যাস ও তেল দিয়ে। এর মধ্যে গ্যাসে ৫১ শতাংশ এবং তেল দিয়ে ৩৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মোট ১১ হাজার ৫২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। সেখানে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। তবে দিনের বেশির ভাগ সময়ে গ্যাস দিয়ে চার হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। দেশে ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেলভিত্তিক মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র রয়েছে সাত হাজার ৬১৯ মেগাওয়াটের। দিনের কোনো কোনো সময় তরল জ্বালানি থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে ৪০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনা হচ্ছে। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত তেলচালিত বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট করা হয়।
আসন্ন গ্রীষ্মের পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম জানান, আসছে গ্রীষ্মে আমি মনে করি চরম একটি লোডশেডিংয়ের সিচুয়েশনে চলে যাব আমরা। পড়তে হবে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। ব্যাহত হবে নিয়মিত কার্যক্রম।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম