চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রলীগের হামলা-সংঘাতের রেশ না কাটতেই চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজসহ অন্তত তিনটি প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হুমকি-ধমকি দেওয়াসহ অশোভন আচরণের অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজে ছাত্রলীগের আন্দোলনের মুখে কলেজ শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষক ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তাঁদের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। ৭ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০ দিনে এসব ঘটনা ঘটে। দুই শিক্ষক থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
চট্টগ্রামের ওমরগনি এমইএস (মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি) কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক ববি বড়ুয়া বলেন, ৭ ফেব্রুয়ারি একাদশ শ্রেণির পাঠদান চলাকালে হঠাৎ নগরের ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হায়দারের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন তাঁর অনুমতি ছাড়া শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন। তিনি অনুমতি ছাড়া ক্লাসে প্রবেশের কারণ জানতে চান। এ সময় রাকিব সবার সামনে তাঁর (শিক্ষিকা) সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। ঘটনার পর কয়েক দিন তিনি কলেজে যাননি। কয়েক দিন ধরে কলেজে গেলেও এখনো ক্লাস নেননি। পাশাপাশি তিনি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে নগরের খুলশী থানায় জিডি করেছেন।
সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ৯ ফেব্রুয়ারি মহসিন কলেজ কেন্দ্রে ডিগ্রি প্রথম বর্ষের হিসাববিজ্ঞান পরীক্ষায় চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের এক ছাত্র (ছাত্রলীগকর্মী) প্রকাশ্যে বই দেখে উত্তরপত্রে লিখছিলেন। ওই সময় তিনি নকলে বাধা দেন। এর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ওই ছাত্র পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরই মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কাজী নাঈমের নেতৃত্বে ছাত্রলীগকর্মীরা এসে তাঁকে (মুজাহিদুল) বদলি করাসহ বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দেন। সহকর্মীকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার প্রতিবাদে কলেজের শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন অধ্যাপক সুবীর দাশ।
আর চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজে বেশ কয়েক দিন ধরে আন্দোলন করছিলেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাঁদের আন্দোলনের মুখে ১৬ ফেব্রুয়ারি কলেজ শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আজম মোহাম্মদ আনোয়ার সাদাত ও শিক্ষক ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ গোলাম মহিউদ্দিন তাঁদের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি সিটি কলেজের বর্ষপঞ্জিকায় পরিকল্পিতভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি না ছাপিয়ে অবমাননা করেছেন ওই দুই শিক্ষক নেতা। ছাত্রলীগের আন্দোলন সঠিক ছিল। তাদের আন্দোলনের মুখে ওই দুই শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ৮ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ পর্বের সমাপনী পরীক্ষা চলাকালে প্রকাশ শিকদার নামের এক শিক্ষকের সঙ্গে কয়েক দফায় অশোভন আচরণ করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় ওই শিক্ষক থানায় জিডি করেছেন বলে জানা যায়। ওই ঘটনায় পলিটেকনিক কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
জানতে চাইলে ওমরগনি এমইএস কলেজের প্রভাষক ববি বড়ুয়া গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ১৩ বছরের অধ্যাপনা জীবনে এ রকম ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে তা কখনো ভাবিনি। ঘটনার পর থেকে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কয়েক দিন আগে কলেজে গেলেও ক্লাস নিতে পারিনি। খুব খারাপ লাগছে। চলতি সপ্তাহ থেকে আবার ক্লাসে যাব। যে এই ঘটনা ঘটিয়েছে সে আমার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চেয়েছে। কয়েক দিন আগে পারিবারিক সিদ্ধান্তে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আমি থানায় জিডি করেছি।’
নগরের খুলশী থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জিডি তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করেছি। অনুমতি পেলে আমরা ওই ঘটনায় তদন্ত শুরু করব।’
অভিযুক্ত ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হায়দারের মোবাইলে গতকাল বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।
সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের শিক্ষক মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এক ছাত্র নকল করতে না পেরে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে যান। এ সময় কাজী নাঈম ওই ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা হলের দরজার সামনে এসে আমাকে কক্ষ থেকে বের হওয়ার জন্য বলে। আমি বের না হলে মারধরের হুমকি দেয়। এ সময় আমাকে বদলি করারও হুমকি দেয়। ঘটনার তিন দিন পর কলেজে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আমারও থানায় জিডি করার কথা ছিল।’
তবে ঘটনায় জড়িত থাকা ও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কাজী নাঈম। গতকাল বিকেলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষককে হুমকি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। ছাত্রলীগ ও কলেজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে সরকারবিরোধীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অশোভন আচরণসহ নানাভাবে হুমকিধমকির ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, যারা এসব অপকর্ম করছে তারা ছাত্রলীগের নামধারী। তারা ছাত্রলীগের আদর্শ মানে না। এ সময় এগুলো করে কারো না কারো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং ছাত্রলীগের আদর্শ ধারণ করে না তারা ছাত্রলীগের হতে পারে না।
সোর্স : কালের কন্ঠ