বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। গ্যাসের দাম একলাফে ১৮১ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ দিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে বিদ্যুতের উৎপাদনও প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। গত বছর জানুয়ারিতে যেখানে উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট সেখানে এ বছার জানুয়ারিতে প্রতিদিন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এর ফলে সারা দেশ তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে। রেশনিংয়ে মাধ্যমে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবাহ করা হয়। এই শীত মৌসুমে যখন বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে কম তখনই দেড় দুই ঘণ্টা টানা লোডশেডিং করা হয়। কোনো কোনো এলাকায় তার চেয়ে বেশিও লোডশেডিং হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। শীত শেষে গ্রীষ্মকাল প্রায় আগত। একই সাথে বোরো মৌসুমে সেচের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় দিগুণ বেড়ে যাবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এই চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। কেননা, বর্তমানে ডলার সঙ্কটের কারণে কয়লা, এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। কয়লা সঙ্কটের কারণে এক মাস বন্ধ ছিল বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ কেন্দ্রে আবার উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে কয়লা আমদানি না করা গেলে এপ্রিলের পর ফের কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক নিজেই এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক সুভাষ চন্দ্র পাণ্ডে বলেন, এখন পাইপলাইনে যে কয়লা রয়েছে তা দিয়ে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট আগামী এপ্রিল পর্যন্ত চালানো সম্ভব। এর মধ্যে এলসি জটিলতা না কাটলে কয়লা আমদানি ব্যাহত হবে। ফলে কেন্দ্রটি চালু রাখা সম্ভব হবে না।
দেশে বর্তমানে তীব্র ডলার সঙ্কটের কারণে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপান স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক বেসরকারি কেন্দ্র জ্বালানি সঙ্কটের কারণে তাদের উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এ অবস্থায় আসছে গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) আসন্ন গ্রীষ্মে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল আমদানির জন্য এলসি খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার সহায়তা চেয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি ফয়সাল খান জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন চালু রাখতে জ্বালানি আমদানি জরুরি। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ডলার সহায়তা চেয়ে চিঠি দেয় সংগঠনটি। চিঠিতে বলা হয়, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্ব সংকটে পড়েছে। বাজারে ডলার সংকটের কারণে কোম্পানিগুলোর পক্ষে বিদ্যুৎ খাতের প্রয়োজনীয় এইচএফও, লুব অয়েল ও ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যমান আর্থিক সংকট ও ডলার-স্বল্পতার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে প্রয়োজনীয় এইচএফও, লুব অয়েল ও ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খুলতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি আমদানি করতে না পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) জানিয়েছে আসছে গ্রীষ্ম মৌসুমে যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা তা সরবরাহ নিশ্চিত করতে জ্বালানি খরচের জন্য অন্তত ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। তবে গত ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৬ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে, যা ১ বছর আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এই রিজার্ভ ৪ মাসের আমদানি বিল মেটানোর জন্য যথেষ্ট।
প্রতি বছর গরম ও সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। রমজানেও চাহিদা বাড়ে। বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত চাহিদা বেশি থাকে। গত বছর এ সময়ে লোডশেডিং অতটা না ভোগালেও জ্বালানি সংকটে ১৯ জুলাই থেকে দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করা হয়। এ লোডশেডিং কোনো কোনো এলাকায় ৮ ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়। শীতে চাহিদা কম থাকায় লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তবে ডলার সংকটে প্রয়োজনীয় জ্বালানির জোগান এখনও নিশ্চিত না হওয়ায় আগামী মাসে শুরু হওয়া গ্রীষ্ম- সেচ ও রমজানে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। জ্বালানি সংকটে শীত মৌসুমেও দিনে এক ঘণ্টা নিয়মিত লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সামনে গ্রীষ্ম মৌসুম। আগামী মাস থেকে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকবে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া সঙ্কট নিরসনের বিকল্প কোন উপায় নেই। এ জন্য কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও জ্বালানি তেল আমদানির ডলারের সংস্থানই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জ্বালানি তেল আমদানিতে ডলার চায় বিআইপিপিএ। আবার বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নিয়মিত বিল দিতে পারছে না পিডিবি। গত আগস্ট থেকে বিল বকেয়া প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এতে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছে না বেসরকারি মালিকেরা। পেট্রোবাংলার কাছে পিডিবির গ্যাস বিল বকেয়া ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঘাটতি মেটাতে সরকার বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানোর চিন্তা করছে বলে পিডিবি সূত্রে জানা গেছে। গত ১১ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১২ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেই বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে। সামনে এই খরচ আরও বাড়বে। এ ছাড়া জ্বালানি খাতে আমলানির্ভরতাকে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম ইনকিলাবকে বলেন, আমদানি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করাই হয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধি করে সমাধান হবে না। এ খাতের মূল সমস্যা এখন ডলারের সংস্থান। এটি করা না গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ থেকেই যাবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ইনকিলাবকে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সব ধরনের জ্বালানি আমদানিতে মাসে গড়ে অন্তত ১২৫ কোটি ডলার লাগে। বিশ্ববাজারে এলএনজি, কয়লার দাম কিছুটা কমতির দিকে। গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তুতি আছে। ইতিমধ্যে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হয়েছে। এখন মূল চ্যালেঞ্জ ডলারের সংকট মোকাবেলা করা।
ডলার সঙ্কটে কয়লা আমদানি না হওয়ায় রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এক মাস বন্ধ রাখতে হয়েছে। কয়লার বিল বকেয়া রেখে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। পাঁচ মাসের বিল বকেয়া থাকায় জ্বালানি তেল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি খাতের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা। নিয়মিত ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এলএনজি আমদানি বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। ডলারের চাহিদা জানিয়ে সব প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিচ্ছে। তাদের ৫ মাসে ৬০০ কোটি ডলার (৬৩ হাজার কোটি টাকা, ডলার ১০৫ টাকা ধরে) লাগবে।
পিডিবি সূত্র বলছে, মে মাসের চাহিদা পূরণে ভারত থেকে ১ হাজার ৭৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনতে চায় সরকারের। এর মধ্যে ৭২৫ মেগাওয়াট আসবে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। তবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসার বিষয়টি এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে মে মাসে ৫ লাখ ৮১ হাজার টন ফার্নেস তেল আমদানি করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৭ হাজার ৪০০ টন আনবে বিপিসি। এ ছাড়া ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তাদের ৬৬ হাজার ১০০ টন ডিজেল আনতে বলা হয়েছে। এর বাইরে পরিবহন ও সেচের জন্য নিয়মিত ডিজেল আমদানি করে বিপিসি। বিপিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সব মিলিয়ে মাসে তাদের দরকার ৪০ থেকে ৪৫ কোটি ডলার, যা পাঁচ মাসে ২০০ থেকে ২২৫ কোটি ডলার। কিন্তু ব্যাংকগুলো নিয়মিত ঋণপত্র খুলছে না। সোনালী, রূপালী, জনতা ব্যাংক থেকে মোটামুটি পাওয়া গেলেও অগ্রণী ব্যাংক ঋণপত্র আটকে দিচ্ছে। ডলার নেই তাদের কাছে। বিদেশি সরবরাহকারীদের বিল বকেয়া পড়ছে। তবু দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে কিস্তিতে বিল পরিশোধের বিষয়টি তারা মেনে নিয়েছে।
সোর্স : ইনকিলাব