যানজট নিরসনে মহাপরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে রাজধানীর চারদিকে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ নিয়ে জটিলতা কাটছে না। পাঁচ বছর আগে সড়কের গাবতলী-বাবুবাজার-কদমতলী অংশের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা ও চূড়ান্ত নকশা করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। কিন্তু এর একাংশে নিজেরাই রাস্তা নির্মাণ করতে চায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন তাদের জমি ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়ায় বৃত্তাকার সড়কের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সড়কের অন্যান্য অংশ নিয়েও আছে বিভিন্ন সংস্থার রশি টানাটানি।
রাজধানী ঘিরে ৮৫ কিলোমিটার বৃত্তাকার সড়কের (ইনার সার্কুলার সড়ক) গাবতলী-বাবুবাজার-কদমতলী অংশের ১২ কিলোমিটার নির্মাণ সবচেয়ে জরুরি হলেও কাজ এগোচ্ছে না। সড়কের অন্যান্য অংশ নিয়ে সমন্বয়হীনতা আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। একেক সংস্থা সমীক্ষা চালাচ্ছে নিজেদের মতো করে। সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা।
২০১৫ সালে অনুমোদিত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসপিটি) মেট্রোরেল, বিআরটির মতো ঢাকা ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। অগ্রাধিকার দিতে বলা হয় ইনার সার্কুলার সড়ককে। এতে রাজধানীর ভেতরে না ঢুকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারবে গাড়ি। এ ছাড়া এক মহাসড়কের গাড়ি ঢাকায় না ঢুকে আরেক মহাসড়কে যেতে পারবে। এতে রাজধানীতে যানজট অনেকাংশে কমে যাবে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ইনার সার্কুলার সড়কের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। বিকল্প পথ না থাকায় ঢাকা থেকে পোস্তগোলা হয়ে চলে পদ্মা সেতুমুখী সব গাড়ি। এতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় যানজট বেড়েছে। পদ্মা সেতুতে যাওয়ার ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়েতে যানজট কমাতে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের তাগিদ আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বৈঠকে।
ইনার সার্কুলার সড়কের প্রথম অংশ অর্থাৎ পূর্ব অংশে ডেমরা থেকে বেরাইদ-পূর্বাচল-তেরমুখ হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার সড়ক (ইস্টার্ন বাইপাস) নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণ ও বাঁধ নির্মাণ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বাঁধ নির্মাণ শেষে তাতে সড়ক নির্মাণ করবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। কত বছর পর তা হবে, নিশ্চিত নয়। কিন্তু এই অংশে উড়াল সড়ক নির্মাণ করতে চায় সেতু কর্তৃপক্ষ।
পাউবো এখন সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করছে। কিন্তু একই অংশে সমীক্ষা করবে সেতু কর্তৃপক্ষও। গত ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) বোর্ড সভাসূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এর আগে ২০২১ সালের ২২ জুন অনুষ্ঠিত সভায় সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, এলিভেটেড ইনার সার্কুলার সড়ক নির্মাণে পরামর্শকের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। গত সপ্তাহে জানিয়েছে, সমীক্ষার কাজ চলমান। অর্থাৎ একই স্থানে দুই সংস্থা সমীক্ষা চালাচ্ছে।
দুটি পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে গাবতলী সেতু থেকে ধউর এবং পোস্তগোলা থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত ২৬ দশমিক ২৪ কিলোমিটার সড়ক দুই পাশে সার্ভিস লেন রেখে চার লেনে উন্নীত করতে চায় সওজ। গত ৬ ডিসেম্বর প্রকল্প দুটির যাচাই কমিটির সভা হয়েছে। গত ১৬ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় প্রকল্প দুটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকা।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইনার সার্কুলার সড়কের চুনকুটিয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ৪ দশমিক ১ কিলোমিটার নির্মিত হয়েছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের অংশ হিসেবে। আবদুল্লাহপুর থেকে ধউর পর্যন্ত ৫ দশমিক ৯০ কিলোমিটার নির্মাণ চলছে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অংশ হিসেবে। শিমরাইল থেকে ডেমরা পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার নির্মাণ চলছে হাতিরঝিল-রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ের অংশ হিসেবে।
তিন প্রকল্পের মাধ্যমে মোট ১৩ কিলোমিটার নির্মাণ করা হচ্ছে।
সওজ আগে বলেছিল, ইনার সার্কুলার সড়কের দৈর্ঘ্য হবে ৮৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার। তবে মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দৈর্ঘ্য ৮৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২৫ কিলোমিটার ইস্টার্ন বাইপাস। বাকি ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩ কিলোমিটার নির্মাণ চলছে বা শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৭ কিলোমিটার নির্মাণে ১২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল চার বছর আগে। কিন্তু কাজ এগোয়নি। এবার এর ২৬ দশমিক ২৪ কিলোমিটার নির্মাণে দুটি ভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
বাকি ২০ দশমিক ৭৬ কিলোমিটারের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত সাড়ে ৫ কিলোমিটার নিয়ে জটিলতা সবচেয়ে বেশি। এই অংশের জমির মালিক দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সংস্থাটি এই অংশসহ সদরঘাট হয়ে লোহারপুল পর্যন্ত ছয় লেনের সড়ক নির্মাণ করতে চায়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডিটিসিএ সভায় বলেন, ইনার সার্কুলার সড়ক বিষয়ে তাঁরা অবগত নন। ১৫তম সভায় একই কথা বলেন উত্তরের মেয়র। দক্ষিণের মেয়র জানান, বছিলা থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ছয় লেনের সড়ক নির্মাণ ডিএসসিসির মহাপরিকল্পনায় রয়েছে।
ইনার সার্কুলার সড়ক প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সওজের প্রকৌশলীরা জানান, সিটি করপোরেশন শহরের অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণে দক্ষ। কিন্তু জাতীয় মহাসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ে মানের সড়ক নির্মাণে সক্ষম নয়। আবদুল্লাহপুর থেকে ধউর-গাবতলী হয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত দুই পাশে সার্ভিস লেন এবং চার লেনের মহাসড়ক হবে। বিনা বাধায় গাড়ি চলতে মোড়ে থাকবে ওভারপাস। সিটি করপোরেশন বুদ্ধিজীবী সেতু থেকে সোয়ারীঘাট পর্যন্ত সাধারণ মানের সড়ক নির্মাণ করলে ইনার সার্কুলার রুটের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।
সওজ সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের আপত্তির কারণে বছিলা মোড় থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু হয়ে কেরানীগঞ্জের ভেতর দিয়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে পর্যন্ত নিতে হবে ইনার সার্কুলার সড়ক। এতে জমি অধিগ্রহণের কারণে ব্যয় বাড়বে; সেই সঙ্গে বাড়বে দূরত্ব। শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুর পাশে আরেকটি চার লেনের সেতু নির্মাণ করতে হবে। এতে ঢাকা ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। রুদ্ধ হবে পুরান ঢাকা থেকে বের হওয়ার বিকল্প পথের পরিকল্পনা।
ইনার সার্কুলার সড়ক প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণ সিটি জমি দিতে রাজি না হওয়ায় গাবতলীতে ইন্টারচেঞ্জ এবং সেখান থেকে বছিলা পর্যন্ত ৪ দশমিক ২৬ কিলোমিটার অংশে দুই পাশে সার্ভিস লেনসহ চার লেনের সড়ক নির্মাণের প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। এতে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। প্রকল্প পরিচালক সবুজ উদ্দিন খান জানিয়েছেন, এ অংশের মাঠ পর্যায়ের সার্ভে চলছে।
সোয়ারীঘাট থেকে সদরঘাট অংশের রাস্তা সরু হওয়ায় সেখানে চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই সেখান থেকে বাবুবাজার সেতুর পাশে আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হবে। সেটি যুক্ত হবে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে যাওয়ার কেরানীগঞ্জের ফ্লাইওভারের সঙ্গে। সওজের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং এর পরিকল্পনা ও নকশা করছে বলে জানিয়েছেন সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শিশির কান্তি রাউত।
চাষাঢ়া থেকে ইনার সার্কুলার সড়কের বাকি অংশ শিমরাইলে গিয়ে মিলবে হাতিরঝিল-রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে। ইনার সার্কুলার সড়ক না হওয়ায় ঢাকা-উত্তরবঙ্গ, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দক্ষিণবঙ্গমুখী যানবাহনের রাজধানী এড়িয়ে পদ্মা সেতুতে যাওয়ার পথ নেই। আবদুল্লাহপুর-ধউর-বিরুলিয়া-গাবতলী-সোয়ারীঘাট-বাবুবাজার-কদমতলী-তেঘরিয়া-পোস্তগোলা-ফতুল্লা-চাষাঢ়া-হাজীগঞ্জ-ডেমরা হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত অর্থাৎ ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ হলে যে কোনো মহাসড়ক থেকে ঢাকায় প্রবেশ না করেই আরেক মহাসড়কে যাওয়া যাবে। সার্কুলার সড়কের পশ্চিমাংশ নির্মাণে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ঋণ চাওয়া হয়েছিল। তবে চীনের ব্যাংকটি আগ্রহ দেখিয়েও সরে গেছে।
বৃত্তাকার সড়ক পরিকল্পনায় ঘুরপাক খাওয়ায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সওজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাস্তবায়নে জটিলতা বেড়েই চলেছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেছেন, আরএসটিপির অগ্রাধিকারের প্রকল্প ইনার সার্কুলার রুট। প্রস্তাবিত আটটি রেডিয়াল সড়কের একটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। ‘ফরোয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে এ সড়ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু ‘ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে ইনার সার্কুলার সড়ক তৈরি হয়নি। এই সড়ক নির্মাণ জরুরি।
সোর্স : সমকাল