চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) দেশসেরা বিদ্যাপীঠের একটি। সেরা মেধাবীরা এখানে ভর্তির সুযোগ পান। অথচ তাঁদের কেউ কেউ মাদক সেবন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে বসেই। হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়ায় মাসতিনেক আগে এখানকার চার শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিস্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মেধাবী মেডিকেলের শিক্ষার্থীরাও। কিন্তু পথভ্রষ্ট হওয়ার চিত্র আছে সেখানেও। মারামারি করে সহপাঠীর মাথার খুলি ভেঙে ফেলার অপরাধে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) থেকে একসঙ্গে ৩০ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিস্কার করার নজির তৈরি হয়েছে। এ চিত্র আরও ভয়াবহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি)। সেখানে প্রতিবছরই কোনো না কোনো অপরাধে বহিস্কৃত হচ্ছেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা। আজীবন বহিস্কার হওয়ার ঘটনাও আছে।
দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে মা-বাবা প্রিয় সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেও জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে পথভ্রষ্ট হচ্ছেন তাঁরা। কেউ হারিয়ে যাচ্ছেন অপরাজনীতির চোরাবালিতে, কেউ মাদকের কাছে। কেউবা পথ হারাচ্ছেন সঙ্গদোষে। এ চিত্রকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা মনে করছেন, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নীতিহীন রাজনীতির চর্চা অব্যাহত থাকলে এবং অভিভাবকরা সন্তানদের ব্যাপারে আরও সচেতন না হলে, এভাবে আরও অনেক মেধাবী মুখ অকালেই ঝরে যাবে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মেডিকেল, প্রকৌশল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়ারা- সবাই মেধাবী। কিন্তু মারামারি, ছিনতাই, মাদক সেবন কিংবা যৌন হয়রানির জন্য তারা বহিস্কার হলে পুরো পরিবারকে তা বজ্রপাতের মতো আঘাত করে। রাজনীতির চোরাবালিও ধ্বংস করে দেয় অনেকের জীবন। তাই শিক্ষার্থীকেই বেছে নিতে হবে সঠিক পথ। অন্যথায় সামান্য ভুলে অনেক বড় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে তাদের। একজন শিক্ষার্থীকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পরিবারকেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, ‘মা-বাবারা অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠান। কিন্তু পাঠানোর পর সন্তান কী করছে, সে খবর রাখেন না। এজন্য অনেকে বেছে নিচ্ছে খারাপ পথ। ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘুরিয়ে দিচ্ছে কারও কারও জীবনের বাঁক।’
মাদক সেবনে বহিস্কার: চুয়েটের এক বিজ্ঞপ্তিতে সম্প্রতি জানানো হয়, চট্টগ্রামের পুরোনো রেলস্টেশনে চুয়েট শিক্ষার্থীদের বাসে মাদক সেবনরত অবস্থায় পাওয়া যায় চার শিক্ষার্থীকে। আংশিক মাদকদ্রব্যও জব্দ করা হয় তাঁদের থেকে। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই স্টুডেন্ট ডিসিপ্লিন কমিটির জরুরি সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর চার শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়। মাদক গ্রহণ করা শিক্ষার্থীরা হলেন ইমরান হাসান মুরাদ, প্রত্যয় দেব, আকিব জাবেদ আসিফ ও আমানত উল্লাহ। তাঁরা যন্ত্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বহিস্কারের ঘটনায় এলোমেলো হয়ে গেছে তাঁদের শিক্ষাজীবন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদের একজন সমকালকে বলেন, ‘আর কখনও এমন ভুল করব না। কিন্তু পরিবারের কাছে তো এখন আর মুখ দেখাতে পারছি না। আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। কিন্তু আগের ঘটনা ভুলতে পারছি না কিছুতেই। পরিবারও এখন আর আমাকে বিশ্বাস করছে না।’
এক দিনেই শাস্তি ৩০ শিক্ষার্থীকে: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় এক দিনেই ৩০ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার করে একাডেমিক কাউন্সিল। গত বছরের নভেম্বরে এ ব্যবস্থা নেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। চমেকের অধ্যক্ষ ডা. শাহেনা আক্তার জানান, প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় আট শিক্ষার্থীকে দুই বছরের জন্য, দু’জনকে দেড় বছরের এবং বাকি ২০ জনকে এক বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়েছে। এই সময়ে তাঁরা কোনো ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। মেডিকেল কলেজে একসঙ্গে এত শিক্ষার্থীকে বহিস্কারের ঘটনা এটিই প্রথম।
চমেক ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ গত তিন বছরে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। গত অক্টোবরে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এ সময় আকিব নামে এক শিক্ষার্থীর মাথার খুলি থেঁতলে দেন তাঁরই সহপাঠীরা। এটি দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বহিস্কৃত সেই শিক্ষার্থীদের অনেকে আবার অপরাধে জড়িয়েছেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না তাঁরা। বহিস্কৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯ জন সম্প্রতি চমেকের চার শিক্ষার্থীকে আবার পিটিয়েছেন। আকিবের মতো এবারও দুই শিক্ষার্থীকে চিকিৎসা নিতে হয় আইসিউতে। অবশ্য ভালো হওয়ার চেষ্টা করছেন কয়েক শিক্ষার্থী।
চবিতেও আজীবন বহিস্কার: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হল এলাকায় গত বছরের ১৭ জুলাই এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের পর আপত্তিকর ভিডিও ধারণের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় দু’জনের ছাত্রত্ব বাতিল করে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাঁদের একজন মোহাম্মদ আজিম। ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি। আরেকজন নুরুল আবছার নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। তাঁরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। একই ঘটনায় হাটহাজারী কলেজে অধ্যয়নরত দুই শিক্ষার্থীরও ছাত্রত্ব বাতিল করে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
একই রকম ঘটনায় এর আগে আরও চার ছাত্রকে এক বছরের জন্য বহিস্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দুই ছাত্রীকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে।
সাংবাদিক হেনস্তা, আবাসিক হল ভাঙচুর, ছিনতাই, মারামারিসহ বিভিন্ন অপরাধে গত বছর একসঙ্গে চবির আরও ১৮ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার করা হয়। এ ছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি, শিক্ষার্থীদের মারধরসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় এর আগেও ১৩ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার করা হয় চবি থেকে। এর আগেও গুরুতর অপরাধে জড়িত কয়েকজনকে সাময়িক বহিস্কার কিংবা তাঁদের ছাত্রত্ব বাতিল করে চবি কর্তৃপক্ষ।
ছাত্রত্ব ধরে রাখতে চাতুরি: চবির নেতা হতে অনেকে আবার স্বেচ্ছায় নষ্ট করছেন নিজের ছাত্রজীবন। শাটল ট্রেনভিত্তিক বিভিন্ন উপগ্রুপ করে ক্যাম্পাসে সক্রিয় থাকা এমন নেতা আছেন অন্তত দুই ডজন। তাঁদের একজন প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয় পাঁচ বছরের কোর্স ১১ বছরেও শেষ করেননি। ভিএক্স গ্রুপের নেতা রায়হান রেজা চবিতে পড়ছেন ১০ বছর ধরে। বাংলার মুখ গ্রুপের প্রধান আবু বকর তোহা ১১ বছর ধরে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রায় এক যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পড়ালেখা’ করছেন রেড সিগন্যাল গ্রুপের নেতা রকিবুল হাসান দিনার। তিনি নাট্যকলা বিভাগের ২০১০-১১ বর্ষের ছাত্র।
সোর্স : সমকাল