সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসিয়া হাওরের একটি বিলের পানি ইজারাদার মাছ ধরার জন্য শ্যালো মেশিন দিয়ে শুকিয়ে ফেলেছেন। এতে হাওরের উঁচু চারটি এলাকার বোরো ধান চাষিরা জমিতে সেচ নিয়ে সংকটে পড়েছেন। বেশ কিছু কৃষক এই সমস্যার কারণে জমি চাষও করতে পারেননি। যাঁরা চাষ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত ২৫ জন কৃষকের ৩৫ একর জমি সেচের অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। লাল হয়ে গেছে জমির ধান। ফলে বোরো ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, উপজেলার শিমুলবাঁক ইউনিয়নের ভাণ্ডা হাজিরা চাতল বিলের উঁচু এলাকা আমড়িয়া, কান্দাগাঁও, রূপাবালি ও খিদিরপুর। চলতি বোরো মৌসুমে এই চার এলাকার অন্তত ৫০ জন কৃষক বিলটির পানি দিয়ে প্রায় ৫০ একর জমি প্রস্তুত এবং এতে ধানের চারা রোপণ করেন। তবে গত পৌষ মাসের মাঝামাঝিতে ইজারাদারের ভাগিদার (সাব-ইজারাদার) জাহির আলী বিলের পানি শ্যালো মেশিন দিয়ে শুকিয়ে মাছ ধরেন। এই পানি তিনি হাওরের আরো নিচের অংশে পাঠিয়ে দেন। ফলে ওই ৫০ একর জমিতে চাষাবাদ হুমকিতে পড়ে। জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে উদ্বিগ্ন কৃষকরা প্রশাসনকে বিষয়টি জানালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাঠে কৃষি কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে দেন। কৃষি কর্মকর্তা এসে অভিযোগের সত্যতা পান। পরে উপজেলা প্রশাসন জমির ধান স্বাভাবিক রাখতে সরকারি স্কিমের সেচযন্ত্র বসিয়ে অনেক দূর থেকে পানি দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে ২৫ জন কৃষকের জমিতে সেচ দেওয়া গেলেও অন্তত ২৫ কৃষকের ৩৫ একর জমিতে নিয়মিত সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে তাঁদের জমি ফেটে চৌচির ও ধান লাল হয়ে গেছে।
অভিযুক্ত সাব-ইজারাদার জাহির আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মত্স্যজীবী সমিতির কাছ থেকে বিলটি সাব-ইজারা নিয়ে মাছ ধরেছি। বিল শুকাইনি।’
কৃষকরা জানান, প্রতিবছর পঞ্চায়েতের টাকায় বাঁধ তৈরি করে ভাণ্ডা হাজিরা ছাতল বিলের (জলমহাল) পানি আটকানো হয়। যাতে সময়মতো সেচ দেওয়া যায়। কিন্তু চলতি মৌসুমে বিলের ইজারাদার অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতেই বিলের পানি সেচে মাছ ধরার কারণে কৃষকরা জমিতে সেচ দিতে পারেননি।
কৃষক আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে ছাতল বিলের পানি দিয়ে হাওরের জমি চাষাবাদ করে আসছি। এবার বিলের মালিকরা অগ্রহায়ণ মাসেই বিলের পানি ছেড়ে দেওয়ায় আমরা চাষকৃত জমিতে সেচ দিতে পারিনি। এখন আমাদের জমি ফেটে চৌচির হয়ে ধান লাল হয়ে গেছে।’
শিমুলবাঁক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফয়জুর রহমান বলেন, ‘এই হাওরের উঁচু অংশ ছাতল বিলের পানি ও নিচু অংশ পাঙ্গাসিয়া খারার (নালা) পানি দিয়ে কৃষকরা চাষাবাদ করেন। পাঙ্গাসিয়া খারায় পানি থাকলেও ছাতলে কোনো পানি নেই। এর জন্য বিলের ইজারাদারই দায়ী। কৃষকদের আবেদনের পর স্কিমের সেচযন্ত্র দিয়ে কিছু পানি দেওয়া গেলেও অন্তত ২৫ জন কৃষকের প্রায় ৩৫ একর জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ধান লাল হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এই সমস্যার কারণে কয়েকজন কৃষক জমিও চাষ করতে পারেননি।’
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, প্রতিবছরই এই মৌসুমে আইন ভঙ্গ করে জলমহাল শুকিয়ে মাছ ধরেন ইজারাদাররা। প্রশাসন বিষয়টি জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এতে একদিকে হাওরের মাছ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে সেচসংকটে ভোগেন হাওরের উঁচু এলাকার চাষিরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদ হাসান বলেন, ‘ছাতল বিলে পানি না থাকায় কিছু কৃষকের সেচে সমস্যা হচ্ছে। আমি সরেজমিনে গিয়ে আংশিক সত্যতা পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।’
শান্তিগঞ্জ ইউএনও আনোয়ার উজ জামান বলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত করিয়েছি। আংশিক সত্যতা পাওয়ার পর স্কিমের সেচযন্ত্র দিয়ে কৃষকের চাষকৃত জমিতে পানি দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখনো আমরা সেভাবে বিষয়টি তদারকি করছি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাওরে পানি নিয়ে একটু সংশয় তৈরি হয়েছে। মাছ চাষিরা কিছু স্থানে পানি সরিয়ে ফেলেছেন। তবে আমরা সে অঞ্চলের সেচের ব্যবস্থা শুরু করেছি। এরই মধ্যে সুনামগঞ্জসহ হাওরের জেলাগুলোতে সেচযন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে।’
সোর্স : কালের কন্ঠ