মানুষের মুখ দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ আনন্দ-বেদনা বোঝা যায় তেমনি একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেই অনুধাবন করা যায় শিক্ষার পরিবেশ। শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড বলা হয়। কারণ শিক্ষা মানুষকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা ছাড়া উন্নত জাতি গড়ে উঠতে পারে না। সেজন্য আমরা আমাদের কলিজার টুকরা সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই। অথচ সেখানে গিয়ে অনেকে সম্মান, মনুষ্যত্ব ও জীবন পর্যন্ত হারায়। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু নয়! দেশ গড়ার কারিগর তৈরি করে। কেউ ইচ্ছে করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে না। এজন্য তাকে ভালো ফলাফল করতে হয়। যারা সেখানে পড়ে তাদের প্রতি বাবা, মা, ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। তারা সেখানে শিক্ষার জন্য যায়। কিন্তু শিক্ষা না নিয়ে কেউ কেউ সন্ত্রাসী, বখাটে, দাগী আসামী কিংবা লাশ হয়ে ফিরে তার আপন ঠিকানায়। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ কত ভারি হয় তা ভুক্তভোগী বাবা ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী যেখানে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ানোর কথা সেখানে কেন শারীরিক নির্যাতন, র্যাগিং ও খুন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মেধা ও মনন চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। অথচ প্রায়ই শিক্ষার্থী নির্যাতনের কথা শোনা যায়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী নিজেদেরকে ভালো মানুষ তথা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে, সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? শিক্ষার্থী পেটানো থেকে শুরু করে র্যাগিং এর নামে নিষ্ঠুরতা চলছে। সম্প্রতি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে রাতভর মারধর ও শারীরিক নির্যাতন করার অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে উঠেছে। পত্রিকার খবর মারফত জানতে পারলাম সানজিদা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। একজন নারী কিভাবে আরেকজন নারীকে নিষ্ঠুর নির্যাতন করতে পারে তা বোধগম্য নয়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু লাগামহীন ক্ষমতার দাপট সভ্য মানুষকেও কখনো কখনো অসভ্য মানুষের কাতারে নিয়ে আসে। যার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। ভুক্তভোগী ছাত্রীর অভিযোগ তাকে চড় থাপ্পর, কিল, ঘুষি কোনোটাই বাদ রাখেনি। কাপড় আটকানোর আলপিন দিয়ে পায়ের ঊরুতে ফুটাচ্ছিল। আপুরা মারার সময় বলছিল, মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে। শুধু নির্যাতন করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি! নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। ওই শিক্ষার্থী পা ধরে ক্ষমা চাইলেও কোনো কথা শোনেনি। অথচ এসময় গণরুমে সাধারণ ছাত্রীরাও ছিল। তারাও ভয়ে কোনো কথা বলেনি। এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের গণরুমে ডেকে নিয়ে ওই ছাত্রীর উপর নিষ্ঠুরতা চালানো হয়। এজন্য তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু সেখানে নির্যাতন হচ্ছে? কেন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থী নিজেদেরকে সভ্য হিসেবে গড়ে তুলেবে, সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? শিক্ষার্থী পেটানো কিংবা হত্যা করার বিদ্যাচর্চা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়! কিন্তু দিন দিন এর মাত্রা বাড়ছে।
একটি রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটি নির্যাতনের ঘটনা খবরের শিরোনাম হচ্ছে। অনিরাপদ হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা। এমন কোন হীন অপকর্ম নেই, যা তারা করছে না। তাদের লাগাম টেনে ধরা দরকার। তারা কখনো দলীয় কোন্দলে কখনো ভিন্নমতের অনুসারীদের হত্যা করছে। রক্তাক্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস। এ দায় ছাত্রলীগ এড়াতে পারে না। তাদের একক আধিপত্যের কারণে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলো সেখানে কাজ করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে উঠছে না। সর্বত্র তাদের একক আধিপত্য বিরাজমান। ফলে টর্চার সেলের নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। আবরার ফাহাদের কথা নিশ্চয় পাঠকের মনে আছে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পৈশাচিক কায়দায় রাতভর নির্যাতন চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। আবরার হত্যার পর হলগুলোতে গণরুম, গেস্টরুম ও পলিটিক্যাল রুম সংস্কৃতির অবসান হবে, এমনটিই সবার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু অদ্যাবধি হয়নি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কেলেজের (চমেক) ৪ শিক্ষার্থীকে কলেজ ছাত্রাবাসে আটকে রেখে মারধরের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। পত্রিকার খবরান্তে জানা যায় ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে বুধবার মধ্যরাত থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। নির্যাতিত ৪ শিক্ষার্থী হলেন, জাহিদ হোসেন ওয়াকিল, সাকিব হোসেন, এম এ রায়হান ও মোবাশ্বের হোসেন শুভ্র। তারা সবাই এমবিবিএস ৬২ ব্যাচের শিক্ষার্থী। নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হওয়া জাহিদ ও সাকিবকে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। সাকিব হোসেন গণমাধ্যমে জানিয়েছেন,গভীর রাতে তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে ক্রিকেট স্ট্যাম্প, পাইপ ও কাঠের তক্তা দিয়ে পেটানো হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেলে কিছুটা বিরতি দিয়ে আবার প্রতিটি গিরার সংযোগস্থলে থেঁতলানো হয়। এমনকি তার ওপর পানি থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। নিঃশ্বাস বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পানি ঢালা চলতে থাকে। পৈশাচিক কায়দায় সহপাঠী পেটানোর সংস্কৃতি কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। কারণ চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ। নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থী আইনের সুবিচার পাবেন এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।
বিশ্ববিদ্যালয়কে মানুষ তৈরির কারখানা বলা হয়। অথচ সেখানে এখন নির্যাতন আর র্যাগিং চাষাবাদ হচ্ছে। ফলে শিক্ষা জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেশনজট বাড়ছে। অথচ বাবা মায়েরা কখনো জমি বন্ধক দিয়ে কখনো হালের গরু বিক্রি করে খরচ পাঠায়। কিন্তু ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী অপর শিক্ষার্থীকে নির্যাতন কিংবা হত্যা করে বাবা মায়ের হাজারো স্বপ্নকে ভেঙে দিচ্ছে। গত ৮ ডিসেম্বর ২০২১ বিচারিক আদালত আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের ঘটনায় ২০ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন বলেন-রায়ে আমি সন্তুষ্ট। তবে ফাঁসির আসামী সবার রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়। আবরার ফাহাদের নিষ্ঠুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতন থামেনি। বরং বেড়েই চলেছে! সব ঘটনার কথা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। নিকট অতীতে মোমেনশাহীর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ নিহাদকে বঙ্গবন্ধু হলের ৩২৪ নাম্বার কক্ষে ডেকে নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শারীরিক নির্যাতন চালায়। যদিও তার কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে সে অপরাধী। কারণ সে ছাত্রলীগের রাজনীতি করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল। সেদিন রাতে ব্যক্তিগত কাজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে সে গিয়েছিল। তারা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রকিবুলের অনুসারী হয়ে চলার আদেশ দেয়। কিন্তু নিহাদ তাদের আদেশে সায় না দেয়ায় তার ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতার ইতিহাস কারও অজনা নয়। কখনো জানান দিয়ে কখনো প্রকাশ্যে নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে শিক্ষার্থীদের ওপর। গেস্টরুম কালচার কী? অভিভাবকেরা না জানলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা টের পায় কত ধানে কত চাল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম কালচার একটি মৃত্যু যন্ত্রণার নাম। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এর ভুক্তভোগী। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে গেস্টরুমে হেনস্তা করা হয়। হেনস্তার শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের অভিযোগের তীরটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের দিকে। কারণ হল প্রশাসন নয়, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন।
ছাত্রলীগের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যোগদানে যেতে কেউ সায় না দিলে কিংবা না গেলে ডেকে গেস্টরুমে ধরে আনা হয়। কৃত অপরাধের জন্য গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এমনকি শিবির অপরাধ দিয়ে হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। যদিও বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে শিবির কোন নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকায় ‘‘লাশ ও খুনি তৈরি করা ছাত্ররাজনীতি” শিরোনামে একটি নিবন্ধ পড়েছিলাম। নিবন্ধের ভাষ্য থেকে যানা যায় স্বাধীনতার ৫০ বছর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী খুন হন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ জন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ জন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ জন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২ জন, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হজরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে শিক্ষার্থী খুন হন। এই শিক্ষার্থীদের পরিবারের স্বপ্নকে যারা ধূলিসাৎ করেছে তাদের কী বিচার হয়েছে আমরা জানি না।
প্রতিটি ন্যক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নিষ্ঠুরতার অবসান হতে পারে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম