আমাদের নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই নানাবিধ বিতর্কের জন্ম দেয়া হয়েছে। পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্খা ও জাতীয় মূল্যবোধের বিপরীতে। ফলে আত্মসচেতন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছে। ফলে অনেকটা তোপের মুখে সরকার ইতিমধ্যেই নতুন পাঠ্যসূচি থেকে দু’টি বই প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নতুন শিক্ষা কারিকুলামে অবৈজ্ঞানিক ডারউইনী বিবর্তনবাদ, ইতিহাস বিকৃতি, নাস্তিক্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা, ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি বিষোদগার, সমকামিতাকে উৎসাহিতকরণ, বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানো, উপমহাদেশের মুসলিম শাসকদের চরিত্রহনন ও হিজাব নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠেছে বেশ জোরালোভাবেই।
এমনকি নতুন পাঠসূচিতে অতিমাত্রায় ভুলভ্রান্তির বিষয়টিও সবার দৃষ্টি কেড়েছে। কিন্তু নেতিবাচক রাজনীতির মারপ্যাঁচে এতোদিন এসব অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করে এসেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমনকি খোদ শিক্ষামন্ত্রী অভিযোগগুলোকে বিরোধী দলের অপপ্রচার ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র হিসাবে আখ্যা দিয়ে দায় শেষ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এতেও বোধহয় পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি বরং সবকিছু কবুল করে নিয়েই ইতোমধ্যেই পাঠ্যসূচি থেকে দু’টি বই প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে শেষ পর্যন্ত গোঁফ নামানো হয়েছে। এতে সরকার পক্ষ স্পষ্টতই স্বীকার করে নিয়েছে যে, পাঠ্যসূচি নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেসব অপপ্রচার নয় বরং অভিযোগগুলোর বস্তুনিষ্ঠতা রয়েছে।
প্রত্যেক রাষ্ট্রের শিক্ষাকারিকুলাম প্রণীত হয় সেদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ^াসকে কেন্দ্র করেই। একই সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের নতুন পাঠ্যসূচিতে এসব বিষয় পরিকল্পিতভাবে উপেক্ষিত হওয়ার জোরালো অভিযোগ উঠেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ-বিশ^াস, আবেগ-অনুভূতি ও ঈমান-আকীদা অনুযায়ী মানুষ ‘বনী আদম’ হলেও সর্বজনীন পাঠ্যসূচি প্রণয়নের নামে একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত দিয়ে পাঠ্যসূচিতে মানুষকে প্রকারান্তরে ‘বনী বানর’ হিসাবে চিত্রিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আমরা বিভিন্ন জীব ও প্রজাতির বিলুপ্তির কথা জেনে এসেছি।
এ বিষয়ে ডাইনোসরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু কোন জীব ও প্রজাতির ভিন্নতর জীব বা প্রজাতিতে বিবর্তন হয়েছে এমন কথা ইতিহাস তো দূরের কথা কোন রূপকথাতেও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। যেমন ‘পুঁটি’ ও ‘কাতলা’ এবং ‘পাবদা’ ও ‘বোয়াল’ মাছ দেহাকৃতি ও অবয়বে দিক থেকে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও ‘পুঁটি’ মাছ ‘কাতলা’ মাছে আর ‘পাবদা’ মাছ ‘বোয়াল’ মাছে রূপান্তর হয়েছে এমন কথা শোনা যায়নি। আর বানর যদি মানুষে রূপান্তর হয়, তাহলে বানরের বিলুপ্তি ঘটলো না কেন এর কোন সদুত্তর সংশ্লিষ্টরা দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। মূলত, ডারউইনী থিউরী সম্পূর্ণ অপ্রমাণিত, অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও কল্পনাপ্রসূত বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অথচ আমাদের দেশের কথিত বুদ্ধিজীবী নামের মওকাজীবীরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে এমন ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে তাদেরকে নাস্তিক্যবাদী ও কুফরীতন্ত্রের দিক্ষা দেয়ার মিশন বাস্তবায়নে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। একই সাথে তারা সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছেন বলেই মনে হচ্ছে।
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সরকার একটা মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন পাঠ্যসূচি প্রণয়নে হাত দিয়েছে। কিন্তু পাঠ্যসূচি প্রণয়নে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে এক্ষেত্রে তারা দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেননি বরং তারা একটি নাস্তিক্য ও বস্তুবাদী চক্রের খপ্পরে পড়েছে। আর সরকারের দুর্বলতা ও সরল বিশ্বাসসকে পুঁজি করে তারা জাতীয় পাঠ্যসূচিতে নিজেদের বিকৃত ও বস্তাপচা দর্শন জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
তবে মুখে সরকার যতই কথামালার ফুলঝুড়ি ফোটাক না কেন তারা যে বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যেই পড়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। একই সাথে মারাত্মক বিড়ম্বনা ও অস্বস্তিতে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। নানাবিধ জটিলতা ও ব্যর্থতায় বছরের প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে সব বিষয়ের সব পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে না পারার ব্যর্থতা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভুলেভরা পাঠ্যবই নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা। উপর্যুপরি ধর্মবিদ্বেষ তো রয়েছেই। জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাঠ্যসূচিতে বিকৃত ও ভুল তথ্য সংযোজনের অভিযোগও উঠেছে। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে, ভুলের সংশোধনী দিয়েও শেষ রক্ষা করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় দুই বিষয়ের বই প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে এনসিটিবি। এতে রাষ্ট্রের ৪০ কোটি টাকার অবচয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এখন এসব বই সংশোধন করে ফের ছাপিয়ে সরবরাহ করতে হবে। আর এর আর্থিক খেসারত দিতে হবে এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে।
বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষাপটে সরকার যখন কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করেছে, তখন লাখ-লাখ পাঠ্যবই বাতিল করে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি গুনতে হচ্ছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানকে। এর সাথে যোগ হয়েছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব। শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় মাসের মাঝামাঝি সময় ইতোমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়েছে। দুই বিষয়ে বই প্রত্যাহার তো রয়েছেই, উপরন্তু এ পর্যন্ত মাধ্যমিকের ক্লাসে সব বিষয়ের পাঠ্যবই হাতে পায়নি শিক্ষার্থীরা। সব মিলিয়ে প্রকৃত অর্থেই যারপরনাই বেহাল দশায় পড়েছে এনসিটিবি। সরকার ও এনসিটিবি বিষয়টি নিয়ে বেশ তৎপর মনে হলেও যাদের ষড়যন্ত্র, দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের জোরালো কোন বক্তব্য নেই। ফলে বিষয়টিতে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
জানা গেছে, এ বছরের বইয়ে খ-িত ইতিহাস অন্তর্ভুক্তি, মুসলিম ইতিহাস বাদ দেয়া, ধর্মবিরোধী, প্রজনন স্বাস্থ্য ও ট্রান্সজেন্ডারের মতো বিষয় পাঠ্য রাখা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে বিভিন্ন মহলে। এছাড়া সার্চ ইঞ্জিন গুগল থেকে হুবহু অনুবাদ তুলে দেয়া এবং অনলাইন থেকে পাঠ নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে বেশ জোরালোভাবে। প্রতি বছর শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসব করে স্কুলপর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় বিনামূল্যের পাঠ্যবই। কাগজ সঙ্কটে এ বছর যথাসময়ে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া নিয়ে যে শঙ্কা ছিল, তাও বাস্তবতা পেয়েছে। জানুয়ারির ১ তারিখ বই উৎসবের দিন সরকার ঘোষণা করে যে, এক মাসের মধ্যে শতভাগ বই পৌঁছবে শিক্ষার্থীদের হাতে। কিন্তু দ্বিতীয় মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চললেও এ ঘোষণার বাস্তবানের কোন লক্ষণ নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন পড়েছে রীতিমত অনিশ্চয়তায়।
সারা দেশে তো বটেই, খোদ রাজধানীর বড় স্কুলগুলোতে পর্যন্ত নতুন শিক্ষাবর্ষের সব শ্রেণির পুরোসেট পাঠ্যবই পৌঁছায়নি। পাঠ্যবই সঙ্কট নিরসনে শিক্ষামন্ত্রী এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে অনলাইন পিডিএফ বই দিয়ে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে। তবে এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দ্বিমত ও অসন্তোষ রয়েছে। তারা বলছেন, শিক্ষকরা পিডিএফ বই দিয়ে ক্লাসে পাঠদান করলেও শিক্ষার্থীরা বাসায় বই ছাড়া অনুশীলন করবে কীভাবে? বিষয়টি একবারে অবাস্তব মনে করছেন তারা।
বইয়ের সঙ্কটের সমাধান না হতেই ১০ ফেব্রুয়ারি আলোচনা-সমালোচনার পর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিকবিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যবই দু’টি প্রত্যাহারের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে এনসিটিবি। বই দু’টির কিছু অধ্যায় ব্যতীত অন্য সব অধ্যায়ের পাঠদান অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের। জানা গেছে, আরও কয়েকটি পাঠ্যবইয়ে শিগগিরই সংশোধনী আনার কথা জানানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে শিগগিরই সংশোধনের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি। কিন্তু এই কর্মযজ্ঞ সম্পাদন কতদিনের মধ্যে করা হবে তার কোন সময়সীমা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিষয়টি নিয়ে এখনো বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের বক্তব্য হলো, ‘অনুশীলনী পাঠ পরিমার্জন করে পুনরায় দেয়া সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে কনটেন্ট অল্প হলে সংশোধনী পাঠানো হবে মাঠপর্যায়ে, আর বেশি হলে বর্ধিত অংশ হিসেবে ফের ছাপানো হবে’। তিনি দাবি করেছেন, ‘দু’টি বই প্রত্যাহার ও নতুন করে কয়েকটিতে সংশোধনের সিদ্ধান্ত সব উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। আমরা এখন যেসব বই সংশোধন হবে, সেগুলোর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছি। তাদের মতামত অনুযায়ী সংশোধনী ছোট হলে আমরা তা সংশোধনী আকারে স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেব। আর বেশি এলে পুরো বই পাল্টে দেওয়া হবে। আশা করছি দ্রুতই সংশোধন করা সম্ভব হবে।’ কিন্তু বিষয়টি বেশ সময়সাপেক্ষ বলেই মনে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালকের নেতৃত্বে যে কমিটি সরকার গঠন করেছে, তারা পরিমার্জনের কাজ করছেন বলেও জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান। এদিকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে এখনও যে বিভিন্ন শ্রেণির সব বই সরবরাহ হয়নি তার চিত্র মিলেছে। আর বই না যাওয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ঠিকমতো শুরু হয়নি। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের বড় স্কুলগুলোতে এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে বইয়ের পিডিএফ ভার্সন ডাউনলোড করে পড়াশোনা চলছে আগে থেকেই। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তারা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব বই এখনো পাননি।
বই সঙ্কট তদুপরি বই বাতিলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষাবিদরা বলছেন, ফেব্রুয়ারি মাসেও সব বিষয়ে পাঠ্যবই স্কুলে পৌঁছায়নি। ক্লাসে ছেলেমেয়েদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। নতুন বই নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার পর দু’টি বই বাতিল ঘোষণায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়ছে। তারা বলছেন, পাঠ্যবইয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রতি বছরই থাকে, এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। আগে পুরোনো কারিকুলামের বই বছর বছর সংশোধন হতে হতে ভুলের পরিমাণ কমে এসেছিল। এবার নতুন কারিকুলামের নতুন লেখা বইয়ে সঙ্গত কারণেই ভুলের পরিমাণ বেশি থেকে গেছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখার সুবিধার্থে পাঠ্যবইয়ে যেসব ভুল-ত্রুটি আসছে এগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশোধন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছানো উচিত।
যখন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সরকার সর্বত্র ব্যয় সাশ্রয়ের কৃচ্ছ্রসাধন নীতিতে চলছে, এই মুহূর্তে লাখ লাখ পাঠ্যবই বাতিল করে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি গুনতে হচ্ছে-এর দায় কার? এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর মিলছে না সংশ্লিষ্টদের কাছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এজন্য জরুরি ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। নতুন কারিকুলাম দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন শুরু করায় ভুলভ্রান্তি নজরে আসছে, এমনটা জানিয়ে কেউ কেউ বলছেন, পাইলটিংয়ে গলদ ছিল এই কারিকুলাম। পরীক্ষামূলকভাবে চালুর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত প্রয়োজনীয় ত্রুটি চিহ্নিত না করেই নতুন পাঠ্যবই তুলে দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের হাতে।
যাদের অপকর্মের কারণে জাতীয় পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাক্রমেই এই বেহাল দশার সৃষ্টি হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব মানবজাতিকে যারা ইতরপ্রাণির উত্তরসূরি হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও কারো মুখেই ‘রা’ নেই। তবে এ বছরের বিতর্কিত পাঠ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের খুঁজে বের করতে গত ৩১ জানুয়ারি দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। একটির নাম দেয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক এই কমিটির প্রধান। কমিটির সদস্য শিক্ষক, ধর্ম বিশেষজ্ঞসহ ৭ জন।
এছাড়া দায়ীদের চিহ্নিত করতে ৭ সদস্যের কমিটি হয়েছে। এর প্রধান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার। বিশেষজ্ঞ কমিটিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের অসঙ্গতি/ভুল/ত্রুটি এক মাসের মধ্যে চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা ও কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে নানাবিধ প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, যারা এসব অপকর্মের সাথে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে কোন কমিটি গঠনের প্রয়োজন নেই। মূলত এরা আত্মস্বীকৃত বিভীষণ। তাই বিষয়টি অনেকেই লোক দেখানোই মনে করছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, হয়তো এই কমিটি নামের ‘পর্বত’ শেষ পর্যন্ত মুসিকও প্রসব করতে পারবে না।
মূলত, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে পাঠ্যসূচিতে নাস্তিক্যবাদী, কুফরী ও ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী ধ্যান-ধারণা অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাতেই অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের দুর্বলতা ও সরল বিশ^াসের সুযোগে একটি চিহ্নিত শ্রেণি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই কাজ করে সরকারকেও বিতর্কিত করে ফেলেছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্বহীনতা ও পেশাদারিত্বের অভাব এবং নেতিবাচক চিন্তা-চেতনা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার হীনমানসিকতা সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। যা আমাদের শিক্ষাকে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকেই ঠেলে দিয়েছে। এমতাবস্থায় দেশ ও জাতিকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে অনতিবিলম্বে ধর্মীয় স্কলারদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে নতুন করে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা দরকার। অন্যথায় জাতি হিসাবে আমাদের গন্তব্যই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম