আবু হেনা মুহিব
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০২:০৮ । প্রিন্ট সংস্করণ
ফলো করুন-
অতিমারি করোনার প্রভাবে মানবসম্পদ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে। এতে লাখো শিশু এবং তরুণের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাদের অনুধাবন শক্তি দুর্বল হয়েছে, যা তাদের সারাজীবনের আয় সক্ষমতা কমাবে। অর্থনৈতিক অবস্থা বিপন্ন করে তুলবে। এ কারণে বাংলাদেশের এখনকার শিশুদের পরিণত স্বাভাবিক যে আয় হতে পারত, করোনার ক্ষতির কারণে তা কমবে অন্তত ২৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী ক্ষতির এ পরিমাণ ২১ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘কভিড-১৯ কীভাবে মানব পুঁজির ক্ষয় করেছে এবং এ ব্যাপারে করণীয় কী’ শিরোনামের বিভিন্ন দেশের তথ্যের প্রাথমিক বিশ্নেষণ নিয়ে তৈরি করা এ প্রতিবেদন গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হয়। ২৫ বছরের কম বয়সীদের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্নেষণে বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, শিশুদের ওপর পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২২ সালের পরীক্ষায় শিশুরা বেশ পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ করোনার প্রভাবে শিশুদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এই পিছিয়ে থাকার কারণে এসব শিশুর পরিণত বয়সে আয় কমবে স্বাভাবিক আয়ের চেয়ে অন্তত ২৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাক-শৈশবকাল মেধা বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। জীবন দক্ষতার ভিত্তিভূমি বলা হয় এ সময়কে। করোনাকালে লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে অনেক শিশু স্কুলে যেতে পারেনি। করোনায় সারাবিশ্বেই বিভিন্ন সময়ের জন্য স্কুল বন্ধ ছিল। নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এক বছরের মতো স্কুল বন্ধ ছিল। এ কারণে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার টিকা পায়নি অনেক শিশু। তাদের পরিবারে ছিল ঘোর দুশ্চিন্তা। এসব কারণে অনুধাবন শক্তি এবং সামাজিক বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। দরিদ্র পরিবারের প্রাক-শৈশব, বিদ্যালয়গামী বয়সের শিশু ও তরুণদের পরিস্থিতি তুলনামূলক খারাপ। এতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বৈষম্য আরও বাড়তে পারে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
মতামত জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী সমকালকে বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে বিশ্বব্যাংক এ নিয়ে গবেষণা এবং জরিপ করছে। তবে তাদের জরিপ এবং গবেষণা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা। শিখন ঘাটতি এবং দক্ষতা ঘাটতির ক্ষতিটাকে তারা বড় করে দেখে। আসলে করোনার কারণে শিক্ষা এবং শিখন কার্যক্রমের যে ক্ষতি হয়েছে, তা শুধু আর্থিক নয়, একই সঙ্গে আর্থসামাজিক। কারণ, শিখন বঞ্চিত শিশুর আর্থসামাজিক অবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সমাজে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। তার মতে, ক্ষতি কিছুটা পূরণে একটাই বড় কাজ তা হচ্ছে, ক্ষতিটাকে আমলে নেওয়া। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সঠিক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন যাদের বয়স ২৫-এর নিচে তাঁরাই ২০৫০ সালের শ্রমবাজারের ৯০ শতাংশ জোগান হবেন। প্রকৃত ক্ষতির বিষয়টি তখন সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে আশার কথা, শিখন ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন কৌশল বেশ ভালোই কাজে দিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়বস্তুর উন্নয়ন এ ক্ষেত্রে দুটি ভালো উদাহরণ। এতে শিখনের জন্য শিশুদের প্রস্তুত হতে সুবিধা হয়েছে স্বল্পমেয়াদে। আর দীর্ঘমেয়াদে কলেজ পর্যায়ে উপস্থিতি বেড়েছে। কমেছে অপরাধ প্রবণতা।
বাংলাদেশের শিশুদের প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুদের কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা, ভাষা ও শারীরিক দক্ষতা বিভিন্ন দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাজুক। স্কুল বন্ধ থাকার সময় দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তবে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকাসহ অন্যান্য কারণে সব শিশুর পক্ষে দূরশিক্ষণের সুযোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের আর্থিক ও সমাজিকভাবে দুর্বল পরিবারের ৩৯ শতাংশ শিশু দূরশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছে। তুলনামূলক উচ্চবিত্ত পরিবারের এ হার ছিল ৬২ শতাংশ।
করোনায় বাংলাদেশে গড়ে সাড়ে ১৪ মাস স্কুল বন্ধ ছিল। এর জেরে অন্তত ২৬ মাসের শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কারণ এর মধ্যে পাঠ্যবইয়ের আগে জেনে নেওয়া কিছু শিক্ষা তারা ভুলে গেছে। এ ছাড়া দীর্ঘ বন্ধের পর স্কুল খুলে দেওয়া হলেও অনেক শিশু আর স্কুলে ফিরতে পারেনি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পরিচালিত করোনায় লকডাউনের সময় ২০ মাস বয়সের এবং গত বছর একই বয়সের শিশুদের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, করোনার প্রভাবে শিশুদের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ঘাটতি বেড়েছে।
সোর্স : সমকাল