মূল্যস্ফীতি চাপে ফেলে দিয়েছে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের। নিত্যপণ্যের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। চার বছর আগে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছিল। কিন্তু সেই বেতনে এখন চলা দায়। তাই দ্রুত নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করতে সরকার ও মালিকপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
শ্রম মন্ত্রণালয়ে কথা বলে জানা গেছে, তারা মজুরি বোর্ড গঠনের কার্যক্রম শুরু করেছে। মালিক ও শ্রমিক পক্ষের কাছে তাদের প্রতিনিধির নামও চাওয়া হয়েছে। দুই পক্ষই নাম দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
শ্রম আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছর পর পর মজুরি বাড়ানোর নিয়ম। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মজুরি পুনর্নির্ধারণ করতে পারে সরকার। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ মজুরি বাড়ানো হয় পোশাক শ্রমিকদের। ওই সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় আট হাজার টাকা। চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে মজুরি বোর্ড গঠন করতে শ্রমিক নেতারা তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন।
তবে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় কার্যাদেশ কম হওয়ায় তাঁরা বিপাকে আছেন। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ব্যবসা সংকটের মুখে পড়বে।
মজুরি নির্ধারণে শ্রম আইনের ১৪১ ধারা অনুযায়ী, জীবনযাপন ব্যয়, জীবনযাপনের মান, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি নির্ধারণ করতে হয়।
গাজীপুরের কোনাবাড়ীর মণ্ডল টেক্সটাইলের শ্রমিক মো. শাহজালাল মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে ভোগ্য পণ্যের দাম এত বেশি যে মাছ-মাংসের নাম ভুলে গেছি। আলু ভর্তা আর ডাল নিত্যসঙ্গী। ১২ হাজার টাকা মজুরি পাই। দুই বছর আগেও মা-বাবার জন্য তিন-চার হাজার টাকা বাড়িতে পাঠিয়েছি। এখন এর অর্ধেকও পাঠানো কঠিন। বাসাভাড়া আর গ্যাস-বিদ্যুতের বিল দিয়ে যা থাকে, তা দিয়ে পাঁচজনের সংসার চালানো যাচ্ছে না।’
সাভারের পোশাককর্মী কল্পনা আখতার বলেন, ‘বর্তমান মজুরি দিয়ে ১৫ দিনও চলে না। ব্যক্তিগত ধার আর সমিতির ঋণে আটকে গেছি। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বাড়িভাড়া বেড়েছে। অসুখ-বিসুখে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার টাকা থাকে না।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে টিসিবির ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি এবং ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাল, ডাল, আটা, ভোজ্য তেল, মাছ, ব্রয়লার মুরগি আর আলু—এমন সব অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গত পাঁচ বছরে বেড়েছে ২৫ থেকে ১৩৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তৌহিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছেন পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা। তাই শ্রমিকদের বিপদ মানে এই শিল্পেরই বিপদ। মজুরি বাড়িয়ে একে সচল রাখতে হবে।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, পাঁচ বছর আগে প্রতি ডলার ছিল ৭৮ টাকা, বর্তমানে ১০৬ টাকা হয়েছে। বর্তমান বাজার বিবেচনায় শ্রমিক মজুরি হওয়া উচিত ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা হয়েছিল আট হাজার টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করা জরুরি। শ্রমিক ফেডারেশনগুলো এর মধ্যে ২০ হাজার থেকে ২৩ হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরি দাবি করেছে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, পরিপালনীয় মানদণ্ড অনুযায়ী যেসব কারখানা চলছে (কমপ্লায়েন্স কারখানা), তারা এই বেতন দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। তবে ছোট ছোট কারখানা বা ঠিকা কারখানাগুলোর এই সক্ষমতা নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার এ ধরনের কারখানাকে ভর্তুকি বা রেশনিংয়ের আওতায় আনতে পারে। মনে রাখতে হবে, ন্যায্য মজুরি থেকে শ্রমিক বঞ্চিত হলে কারখানাগুলো উৎপাদন সক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছে ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম সাত মাস জুলাই-জানুয়ারিতে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে তিন হাজার ২৪৩ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। পোশাক খাতে এ সময় আয় হয়েছে দুই হাজার ৭৪১ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশের বেশি।
এ বিষয়ে শ্রমিক নেত্রী ও গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, পাঁচজনের একটি পরিবার চলতে মাসে ৪০ হাজার টাকার বেশি লাগে। তাই শ্রমিকদের জন্য দ্রুতই মজুরি বোর্ড গঠন করা উচিত।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কত হওয়া দরকার, তা নিয়ে গত জানুয়ারিতে একটি সমীক্ষা চালায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, এসব শ্রমিকের এখন গড় ন্যূনতম মজুরি হওয়া দরকার ২১ হাজার ৪১৫ টাকা বা ২০২ ডলার।
বিলস সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাস ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও আশুলিয়া এলাকার শ্রমিক, মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তা, মালিক, বিজিএমইএ নেতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতের লোকদের সঙ্গে কথা বলে এই সমীক্ষা করা হয়।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোফিন্যান্স অপরচুনিটিজের (এমএফও) যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার ফলে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের নির্ধারিত কাজের বাইরেও অতিরিক্ত কাজ (ওভারটাইম) করতে হচ্ছে। এতে তাঁদের আয় কিছুটা বাড়ছে। তার পরও পুরো মাসের ব্যয় চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।
সানেমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার এক ওয়েবিনারে বলেছেন, খাদ্য ও অতিরিক্ত বাসাভাড়া বহন করতেই পোশাক শ্রমিকদের মজুরির বড় অংশ চলে যাচ্ছে। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত একজন শ্রমিকের মাসিক বাসাভাড়া ছিল তিন হাজার ৫০০ টাকা, যা দুই বছরের মধ্যে ১৭ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, শ্রম আইন অনুসারে, প্রতিবছর শ্রমিকের মজুরি বাড়ে। বর্তমান শ্রম আইন অনুসারে প্রতিবছর শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়, যা আগে কখনো ছিল না। তিনি বলেন, মজুরি বাস্তবায়নের সময় এখনো হয়নি। এখনো প্রায় এক বছর সময় আছে মজুরি বাস্তবায়নের।
মজুরি বোর্ড গঠনের কার্যক্রম শুরু : শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, শ্রম আইন অনুসারে চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে নতুন মজুরি কাঠামো করতে হবে। এরই মধ্যে মজুরি বোর্ড গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধির নাম চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজীম বলেন, মজুরি বোর্ডে নাম পাঠানোর জন্য চলতি মাসেই বিজিএমইএর বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পাঁচ বছর পর পর মজুরি বাড়ানোর নিয়ম থাকলেও এ খাতের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে তা বাড়াতে হবে। শুধু রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি দেখলে হবে না, এতে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে কি না—এমন অনেক কিছু দেখতে হবে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইপিবি তাদের তথ্যে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি দেখালেও প্রকৃতপক্ষে মালিকরা খুব বেশি লাভবান হন না। কারণ বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় কার্যাদেশ কম পাওয়া—এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। ক্রেতাদের কাছ থেকে পোশাকের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এখন কারখানা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। সার্বিক প্রেক্ষাপট, বৈশ্বিক মন্দা ও বাজার পরিস্থিতি আমলে নিয়ে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।
সোর্স : কালের কন্ঠ