দেশের অন্তত ৭৫টি সংসদীয় আসনে জনসংখ্যার বড় ব্যবধান রেখেই সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
Advertisement
এসব সংসদীয় আসনে সংশ্লিষ্ট জেলার গড় জনসংখ্যার চেয়ে ২৬ থেকে ৮৮ শতাংশ পার্থক্য রয়েছে। এই ৭৫টির মধ্যে ১৮ আসনে জনসংখ্যার ব্যবধান ৫১-৮৮ শতাংশ। বাকি ৫৭টি আসনে জনসংখ্যার ব্যবধান ২৬ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে। এ পার্থক্যের কারণে ঢাকা জেলার গড় জনসংখ্যার চেয়ে একটি আসনে ৮৮ শতাংশ বেশি মানুষ আছে।
অপরদিকে আরেকটি আসনে গড় থেকেও ৬৩.৩১ শতাংশ কম জনসংখ্যা রয়েছে। অথচ দুটি আসনের সংসদ সদস্যের মর্যাদা একই।
এ ব্যবধান রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ হলে যশোর-৩ আসনের নির্বাচিত সংসদ-সদস্য আট লাখ ২ হাজার ৯৪৪ জন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন। অপরদিকে একই জেলার যশোর-৬ আসনের জনপ্রতিনিধি হবেন দুই লাখ ৮০ হাজার ৯৩১ জনের।
জনসংখ্যার এতবড় ব্যবধানের কারণে আসনভিত্তিক সংসদ-সদস্য প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয়সহ অন্যান্য কার্যক্রমেও ভিন্নতা আসবে। জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩০০ সংসদীয় আসনের জনসংখ্যা পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জনশুমারি অনুযায়ী দেশে এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার।
সংসদীয় আসনের সীমানার খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সামনের সপ্তাহে খসড়া অনুমোদন হবে বলে আশা করছি। এরপর তা খসড়া আকারে গেজেট প্রকাশ করব।
ইসি সূত্র জানায়, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে এবারের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এটি গুরুত্ব দেওয়া হলে অনেক আসনের সীমানা পরিবর্তন হবে। সেই পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক হতে পারে-এমন শঙ্কা রয়েছে ইসির।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নতুন গঠিত প্রশাসনিক এলাকা অন্তর্ভুক্ত করে এবার সীমানার খসড়া তৈরি করছে ইসি সচিবালয়। যদিও আইনে প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনা করে ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার পাশাপাশি সর্বশেষ আদমশুমারির প্রতিবেদনে উল্লিখিত জনসংখ্যার যতদূর সম্ভব বাস্তব বণ্টনের কথা বলা হয়েছে।
জনসংখ্যার বড় পার্থক্য রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মনে করেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক ড. মো. আব্দুল আলীম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত গাইড লাইন হচ্ছে গড় জনসংখ্যার কম বা বেশি ৫ শতাংশ পার্থক্য থাকতে পারে।
এর বেশি পার্থক্য হলে সঠিক হারে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ না হওয়ার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, আমাদের এ সংক্রান্ত আইনটি সেকেলে। এ আইনের অধীনে কোনো বিধিমালাও নেই।
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ড. শামসুল হুদার কমিশন গড় জনসংখ্যার কম-বেশি সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশকে মানদণ্ড ধরেছিল। ওই মান ধরে ২০০১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করে। তখন দেশের মোট জনসংখ্যাকে ৩০০ আসন সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে একটি জেলায় কতটি আসন হবে-তা নির্ধারণ করা হয়।
এরপর ওই জেলার জনসংখ্যাকে আসন সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিয়ে গড় জনসংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই গড় জনসংখ্যা, এক জেলার সংসদীয় আসন আরেক জেলায় না যাওয়া এবং ইউনিয়ন ও সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড একাধিক সংসদীয় আসনে বিভাজন না করার নীতিমালা অনুসরণ করে। তবে বর্তমান কমিশন ২০১৮ সালের সীমানাকে মূল ভিত্তি ধরে নতুন সীমানা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে খুব একটা পরিবর্তন আসছে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনি এলাকা বিভাজন আইনে প্রশাসনিক সুবিধা, ভৌগোলিক অখণ্ডতাসহ চারটি ধাপ বলা আছে। এর মধ্যে চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে জনসংখ্যা। জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করা কখনও সম্ভব নয়। এতে শহর এলাকায় আসন বেড়ে যাবে এবং চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ গ্রামাঞ্চলের আসন কমে যাবে।
জনসংখ্যার বড় পার্থক্য রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সীমানা বিভাজনের খসড়া প্রকাশ করব। সেগুলোর ওপর যেসব দাবি আপত্তি আসবে, সেগুলোর শুনানিতে আমরা সব বিষয় চুলচেরা বিশ্লেষণ করব। এরপর চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করা হবে। সবকিছু বিশ্লেষণের জন্য এখনো সময় রয়েছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শহরের আসনগুলোতে জনসংখ্যা বেড়েছে। অপরদিকে গ্রামের আসনে জনসংখ্যা কমেছে। বর্তমানে সবচেয়ে কম জনসংখ্যা রয়েছে ঝালকাঠি-১ আসনে। ওই আসনে জনসংখ্যা দুই লাখ ৫৬ হাজার ৩৪৬জন। অপরদিকে ঢাকা-১৯ (সাভার) আসনে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ১৯ লাখ ২ হাজার ২৯ জন রয়েছেন। গাজীপুর-১ ও ২ আসনের প্রত্যেকটিতে ১৬ লাখের বেশি জনসংখ্যা। ঢাকায় ২০টি আসনে জনসংখ্যার গড় ১০ লাখ ১০ হাজার ৯৬৯। অথচ এ জেলার ১৬টি আসনেই গড় হিসাবের চেয়ে জনসংখ্যা কম। বাকি চারটি-ঢাকা-২, ৩, ১৮ ও ১৯ আসনে গড় হার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ রয়েছেন।
আরও দেখা গেছে, ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে অন্তত ৭৫টিতে জনসংখ্যার বড় ব্যবধান রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি আসনে ওই জেলার গড় জনসংখ্যার চেয়ে ৫১-৮৮ শতাংশ পর্যন্ত পার্থক্য রয়েছে। আসনগুলো হচ্ছে-ঢাকা-১৯ (৮৮.১৪ শতাংশ), ময়মনসিংহ-৪ (৮৬.১৯), নারায়ণগঞ্জ-৪ (৮৬.৪৯), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (৭৫.৫৯), যশোর-৩ (৫৬.৫৮), বরিশাল-৫ (৫৩.২৯), পিরোজপুর-১ (৫০.৩৯), ঢাকা-৪ (-৫৯.৫৯), ঢাকা-৬ (-৫৮.৬০), ঢাকা-৭ (-৫২.৯৮), ঢাকা-১০ (-৫৪.৫৩) ও ঢাকা-১২ (-৫৫.৬১)। এ তালিকায় আরও রয়েছে-গাজীপুর-১ (৫৬.২৬), গাজীপুর-২ (৫৪.৬৫), গাজীপুর-৪ (-৬৩.৯৯), গাজীপুর-৫ (-৫৭.১২), নোয়াখালী-৪ (৬৫.২১) এবং ঢাকা-৮ (-৬৩.৩১)।
এর বাইরে ৫৭টি আসনে সংশ্লিষ্ট জেলার গড় জনসংখ্যা ২৬-৫০ শতাংশ কম বা বেশি রয়েছে। আসনগুলো হচ্ছে-ঠাকুরগাঁও-১, নীলফামারী-৩, রংপুর-৩, বগুড়া-৫ ও ৭, নওগাঁ-১, ঝিনাইদহ-২, যশোর-৬, খুলনা-৩, পটুয়াখালী-১, ভোলা-৪, পিরোজপুর-৩, জামালপুর-২, ৪ ও ৫, ময়মনসিংহ-২ ও ৩, নেত্রকোনা-২ ও ৫ এবং কিশোরগঞ্জ-১। আরও রয়েছে-মুন্সীগঞ্জ-২, ঢাকা-১, ৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ ও ২০, নরসিংদী-১ ও ৩, নারায়ণগঞ্জ-২ ও ৩, সুনামগঞ্জ-২ ও ৫, সিলেট-১, ২ ও ৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ ও ৬, কুমিল্লা-৬, ৭ ও ১০, নোয়াখালী-২, লক্ষ্মীপুর-১, চট্টগ্রাম-৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১২ ও ১৪, কুড়িগ্রাম-২ এবং কক্সবাজার-৩।
সোর্স : যুগান্তর