সরদার আবদুর রহমান : উজানে অসংখ্য বাঁধ, প্রকল্প ও ক্যানেল তৈরি করে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে গঙ্গা-পদ্মার ফারাক্কা পয়েন্টে পৌঁছাচ্ছে না যথেষ্ট পরিমাণ পানি। ফলে বাংলাদেশ অংশের পদ্মায় খরা মওসুম শুরুর আগেই চর আর চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। এতে কার্যত বেহাল দশা দাঁড়িয়েছে পদ্মার।
বাংলাদেশকে গঙ্গার পানিৃর হিস্যা দেয়ার জন্য বর্তমানে যে চুক্তি রয়েছে তার শর্ত অনুযায়ী গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পানি পাবার কথা। খরার সময় ফারাক্কা পয়েন্টে ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি পানিপ্রবাহ থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক পানি, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশ ৩ দফা ১০ দিনের হিসাবের ক্রমানুসারে ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি পাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, খরা মওসুমসহ সারা বছর ফারাক্কার একেবারে উজানের দিকে যে পরিমাণ পানি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় তাতে শর্তানুযায়ী পানি পাবার কথা নয়। কেননা গঙ্গার ১০ ভাগ পানিও ফারাক্কা পয়েন্টে এসে পৌঁছাতে পারে না। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গঙ্গার উৎস থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত বহু বাঁধ আর কৃত্রিম খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে ভারত। শুধু ফারাক্কা বাঁধ নয়, কানপুরের গঙ্গা ব্যারাজ ও হরিদুয়ারে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারে নির্মিত কৃত্রিম খালসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে তারা। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশত পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। পরিণতিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের হাজারো চিৎকার আর আহাজারি সত্ত্বেও ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকার ফলে বাংলাদেশ তার ‘নায্য হিস্যা’ দূরে থাক সাধারণ চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারবে না।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আলোকে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে মে মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি ও বাংলাদশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করা হয়। এবারেও তা করা হয়। এতে দেখা যায়, চলতি বছর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম। গত বছর এই সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ছিল ১ দশমিক ১০ লাখ কিউসেক। এ বছর রয়েছে ১ দশমিক ৬ লাখ কিউসেক। অর্থাৎ এখনই পানি আসতে শুরু করেছে। ভর খরা মওসুমে কী দশা দাঁড়াবে তা অনুমান করা মুশকিল বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
এরই মধ্যে পদ্মার বুক চিরে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল চর। সেখানে চকচকে নতুন টিন দিয়ে নির্মিত হয়েছে ঘরবাড়ি। ফসলাদির চাষ হচ্ছে। গরু, ছাগলসহ বিভিন্ন গবাদি পশুও চরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পদ্মার একুল থেকে ওকুল তাকালেই চোখে পড়তো বিশাল জলরাশি আর ঢেউয়ের পর ঢেউ। সেই পদ্মা এখন ছোট নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীতে চরের বিস্তারের পাশাপাশি পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ অন্তত ৩৬টি নদী কার্যত মৃত খালের রূপ নিয়েছে। এবার শুকনো মওসুম শুরুর আগেই গঙ্গায় পানির সংকটের প্রভাবে বাংলাদেশের পদ্মা শুকিয়ে মরা গাঙ্গে পরিণত হতে শুরু করেছে। পদ্মার বুক চিরে চলাচল করছে বালুবাহী ট্রাক, চাষাবাদও চলছে অনেক স্থানে। ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী পানি না পাওয়া অব্যাহত থাকায় এই পরিস্থিতি হচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশের বৃহত্তম প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প, পানাসি প্রকল্প, বরেন্দ্র প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার একর জমিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পাম্প ব্যবহার করেও সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
পদ্মা নদীর পানির সাধারণ প্রবাহও হ্রাস পেয়ে চলেছে। পানি না থাকায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পিলারগুলো একে একে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সেগুলোতে শুকনো চর জেগে উঠেছে। যেগুলোর গোড়ায় পানি আছে তার আশপাশেও মানুষ চাষাবাদ করছে। নদীতে মাছ নেই, জেলেরা নৌকা দিয়ে জাল টেনে নিজেদের খাবারের মাছও যোগাড় করতে পারছে না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ জানায়, একারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ৫ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন পানির স্তর আড়াইশ থেকে ৩শ ফুট নিচে রয়েছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর আরো নিচে নেমে যাবে। এভাবে চললে ১০ বছর পর এ অঞ্চলে পানি পাওয়া কঠিন হবে। তাছাড়া বৃষ্টিপাত না থাকায় বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম