দিন-রাত মিলিয়ে দুই-তিন ঘণ্টাও ঠিকমতো সরকারি গ্যাস পান না রাজধানীর দুই-তৃতীয়াংশ এলাকার বাসিন্দা। গ্যাস আসে গভীর রাতে। দিনের বেলা কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস থাকলেও চাপ থাকে না। ফলে লাকড়ি, ইলেকট্রিক চুলা, রাইস কুকার, কেরোসিনের স্টোভ বা এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করে রান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। চুলা না জ্বললেও সরকারি গ্যাস গ্রাহকদের মাসিক বিল ১০৮০ টাকা ঠিকই গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিকল্প উপায়ে রান্নার জন্য মাসে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এতে বাড়তি আর্থিক চাপে পড়েছেন সীমিত আয়ের গ্রাহকরা।
রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি তিতাস গ্যাস প্রতিবছর আবাসিক খাত থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আয় করছে। ভোক্তাদের অভিযোগ, তিতাসের দুই-তৃতীয়াংশ গ্রাহক প্রয়োজনীয় প্রবাহে গ্যাস পাচ্ছেন না। তাঁদের দাবি, গ্যাস না দিয়েও বছরে দুই হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করছে তিতাস। প্রিপেইড মিটার থাকলে এই বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকত না। তাই প্রিপেইড মিটার স্থাপনে তিতাসের আগ্রহ খুবই কম। গত ১২ বছরে মাত্র ১০ শতাংশ গ্রাহকের ঘরে প্রিপেইড মিটার দিয়েছে তিতাস। পুরোনো প্রিপেইড গ্রাহকদের নতুন মিটার দিতেও গড়িমসি করছে।
বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত জুলাই থেকে খোলাবাজার বা স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখে সরকার। এর পর থেকেই দেশে গ্যাস সংকট ভয়াবহ রূপ নেয়। শিল্প, আবাসিক, পরিবহনসহ সব খাতেই চলছে হাহাকার।
দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন কার্যক্রমের যেসব উদ্যোগ সরকার ইতোমধ্যে নিয়েছে, তাতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন আগামী এক-দেড় বছরে তেমন বাড়বে না বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকার গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আবাসিক গ্রাহকদের বিকল্প জ্বালানি, বিশেষ করে এলপিজি বা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রকৃতপক্ষে দৈনিক ৪২০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে গড়ে ২৬০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা এলএনজি থেকে আসছে ৪০ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেওয়া হচ্ছে প্রায় ৮৫ কোটি ঘনফুট। শিল্পের নিজস্ব বিদ্যুতে (ক্যাপটিভ পাওয়ার) দেওয়া হচ্ছে ৮ দশমিক ২৯ কোটি ঘনফুট। সার কারখানায় দেওয়া হচ্ছে ১০ দশমিক ৬০ কোটি ঘনফুট। ঢাকা ও এর আশপাশের জেলায় দিনে ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে তিতাস দিচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪২ কোটি ঘনফুট।
চুলা জ্বলে না, তবুও বিল :ভোরে উঠেও পুরো রান্না করা সম্ভব হয় না। কারণ, সকাল না হতেই গ্যাসের প্রবাহ কমে যায়। সারাদিনই গ্যাস মেলে না। গ্যাস না পেলেও মাস শেষে ঠিকই বিল দিতে হচ্ছে। গত মঙ্গলবার সমকালকে এভাবেই ভোগান্তির কথা জানালেন গোপীবাগ এলাকার তৃতীয় লেনের বাসিন্দা মেহেরুন নেছা, যিনি একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। রাজধানী ও আশপাশের জেলাতেও একই চিত্র।
ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শ্যামপুর, সূত্রাপুর, পুরান ঢাকা, আজিমপুর, কামরাঙ্গীরচর, রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগ, মুগদা, কল্যাণপুর, উত্তরাসহ রাজধানীর দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় গ্যাসের সংকট তীব্র। এসব এলাকায় দিনে দুই-তিন ঘণ্টার বেশি গ্যাস থাকে না পাইপলাইনে। গ্যাস আসে গভীর রাতে। ফলে অধিকাংশ বাড়িতেই পাইপলাইনের গ্যাসে রান্না করা সম্ভব হয় না।
গত সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মুগদা ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাড়িতেই পাইপলাইনের গ্যাসের চুলা বন্ধ। রান্না হচ্ছে মাটির চুলা অথবা সিলিন্ডার গ্যাসে। অনেক বাসায় ইলেকট্রিক চুলা, কুকারেও রান্না করতে দেখা গেছে। অধিকাংশ হোটেলে ব্যবহার করা হচ্ছে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার।
শ্যামপুরের অটবির মোড় এলাকার একটি তিনতলা বাসার নিচতলায় থাকেন মাসুম-লাবণী দম্পতি। দু’জনই পোশাক কারখানায় কাজ করেন। সকাল ৭টায় বাসা থেকে বের হতে হয়। তাই বাসার গণচুলায় ভোরে উঠেই রান্নার কাজ সারেন লাবণী। কিন্তু গত কয়েক মাস থেকে ভোরে উঠেও কাজ হচ্ছে না। কারণ, ভোর ৫টার মধ্যেই গ্যাস চলে যায়; আসে রাত ১১টার পর। কারখানা থেকে ফিরে এত রাতে রান্না করে সকালে ওঠা কষ্টকর। তাই ঘরের পাশে একটি মাটির চুলা বসিয়ে তাতেই রান্নার কাজ সারছেন। তিনি জানান, মাসের এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকার লাকড়ি লাগছে। আবার গ্যাস চুলার জন্য প্রতি মাসে বিল দিতে হয়।
দক্ষিণ মুগদার মদিনাবাগ এলাকার বাসিন্দা খালেদ আজিজ জানান, গত বছরের জুলাই থেকে তাঁরা ইলেকট্রিক চুলায় রান্না করছেন। কারণ গভীর রাত ছাড়া গ্যাস মেলে না। এই শীতে পানি গরম করতে ইলেকট্রিক কেটলি ব্যবহার করেছেন। খাবার গরম করেন ওভেনে। সব মিলিয়ে মাসে দেড় হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে। মাসে ১০৮০ টাকা গ্যাস বিলও দিতে হচ্ছে। তাঁর ভবনের ছয়টি ফ্ল্যাটের একই চিত্র বলে জানান খালেদ আজিজ।
দক্ষিণ বনশ্রীর কে-ব্লকের ৭ নম্বর রোডের বাসিন্দা রাকিব হোসেন জানান, দেড় বছর ধরে তিনি সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন। মাসে দেড় সিলিন্ডার গ্যাসে তাঁদের চার সদস্যের পরিবারের রান্নার কাজ হয়ে যায়। দুই মাস আগেও ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাস ১ হাজার ৩০০ টাকায় কেনা যেত। এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। গ্যাস বিল দেওয়ার পরও মাসে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে রান্নার পেছনে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা আকবর হোসেন বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে গত কয়েক মাসে চারজন ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে দিয়েছেন।
সংকট কারখানা ও সিএনজি স্টেশনেও :এদিকে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, সাভার, ময়মনসিংহ এলাকার শিল্পকারখানা গ্যাস সংকটে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। কারখানার মালিকরা বলছেন, যেসব কারখানা চালাতে গ্যাসের চাপ প্রয়োজন ১৫ পিএসআই (প্রতিবর্গ ইঞ্চিতে চাপ), সেখানে মিলছে ২/৩ পিএসআই। কারখানা চলবে কেমন করে? ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ৬৪টি কারখানায় বিকেএমইএ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, গত দুই মাসে গড়ে গ্যাসের চাপ ছিল ১ দশমিক ৮ পিএসআই। সংকট চলছে সিএনজি স্টেশনগুলোতেও। ফলে গ্যাসচালিত পরিবহনগুলোও পড়েছে দুর্ভোগে।
প্রিপেইড মিটারে ধীরগতি :একজন আবাসিক গ্রাহকের দুই চুলার বিল ১০৮০ টাকা। তিতাসের হিসাবে ডাবল চুলার একজন গ্রাহক মাসে ৬০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সাধারণ পরিবারে মাসে ৩৬ থেকে ৪০ ঘনমিটারের বেশি গ্যাস ব্যবহূত হয় না, যদি সরবরাহ ঠিক থাকে। প্রিপেইড মিটার হলে ৪০ ঘনমিটার ব্যবহারে গ্রাহককে মাসে ৭২০ টাকা বিল দিতে হতো। অর্থাৎ প্রিপেইড মিটারবিহীন একজন গ্রাহক থেকেই তিতাস মাসে বাড়তি নিচ্ছে ৩৬০ টাকা। মিটারবিহীন গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ৫০ হাজার। এতে মাসে তিতাসের বাড়তি আয় হয় প্রায় ৮২ কেটি টাকা। সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ, প্রিপেইড মিটার থাকলে আয়ের সুযোগ কম বলে এ প্রকল্পে তিতাস কর্মকর্তাদের আগ্রহ কম। ২০১১ সালে শুরুর পর এ পর্যন্ত ১৩ বছরে ঢাকায় তিতাস মাত্র ৩ লাখ ২ হাজারের মতো মিটার স্থাপন করেছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, তিতাসের দুই-তৃতীয়াংশ আবাসিক গ্রাহক ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছেন না। কিন্তু প্রতি মাসে বিল দিতে হচ্ছে। প্রিপেইড মিটার থাকলে এই বাড়তি বিল দিতে হতো না। কিন্তু সেই প্রিমেইড মিটার দিতে চায় না তিতাস। তিনি বলেন, গ্যাস না দিয়েও বছরে দুই হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে তিতাস বাসাবাড়ির গ্রাহকদের কাছ থেকে। তিনি বলেন, বহু প্রিপেইড গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, তাঁদের মিটার পুরোনো হওয়ার পর তিতাস নতুন করে প্রিপেইড মিটার দিতে চাইছে না।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি সমকালকে বলেছিলেন, সারাবিশ্বেই সংকট চলছে। এরই প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। এ জন্য বিদ্যুৎ-জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে নানান সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন করে স্পট এলএনজি কেনা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে তা পাইপলাইনে যুক্ত হবে। তবে শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের বাড়তি নজর থাকবে। তাই সংকটকালে বাসাবাড়িতে এলপিজি ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ সমকালকে বলেন, গ্যাস সরবরাহ বাড়লে গ্রাহকরা ঠিকমতো গ্যাস পাবেন।
সোর্স : সমকাল