রাজধানীসহ দেশের কিছু এলাকায় জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করার পর সনদের প্রিন্ট কপি পেতে দেরি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তিসহ নানা ক্ষেত্রে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেছে, জালিয়াতি ও প্রতারণা রোধে লগ ইন সিস্টেমে পরিবর্তন আনার পর ব্যবহারকারীরা তা মেনে না চলায় এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্র বলেছে, এ পরিস্থিতির জন্য সার্ভারের কোনো সমস্যা দায়ী নয়। বরং যেসব ব্যবহারকারী (অফিশিয়াল) একই ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড একাধিক কম্পিউটারে ব্যবহার করতেন, সেটা এখন পারছেন না বলে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সমাধান করতে হলে তাঁদের ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) দিয়ে যেকোনো একটি ডিভাইসে লগইন করতে হবে। যাঁরা এটা করছেন না, তাঁদের জন্য সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি মাসে জন্ম নিবন্ধনের আবেদন জমা পড়েছে ১৯ লাখ দুই হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে ১৫ লাখ পাঁচ হাজার ১৬০টি নিবন্ধন করা হয়। সেখান থেকে ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪টি জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রিন্ট দেওয়া হয়েছে। একই সময় জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের আবেদন জমা পড়ে ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৪৬টি। সংশোধন করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৯টি, চলমান বা দেওয়া হয়নি পাঁচ লাখ ৫৮ হাজার ৩৬৭টি আবেদন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জন্ম নিবন্ধন সনদ না পাওয়া এই বিপুলসংখ্যক নাগরিক নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
সরেজমিনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কয়েকটি আঞ্চলিক অফিসে গিয়ে নাগরিকদের দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও অনেক প্রত্যাশীকে সনদ না নিয়ে ফিরে যেতে হয়। বিশেষ করে গত জানুয়ারি মাসে এই সমস্যা বেশি হয়েছে। স্কুলে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের এ নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৪ কার্যালয়ে তাসমিয়া রহমান নামের এক গৃহিণীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, জানুয়ারি থেকে ছেলের জন্ম নিবন্ধনের জন্য ঘুরছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আমার ছেলেকে কল্যাণপুরের একটি স্কুলে ভর্তি করাতে জন্ম নিবন্ধন খুব জরুরি ছিল। এখানে কয়েকবার এসেও না পেয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনেক অনুরোধ করে ভর্তি করিয়েছি। কিন্তু এখনো সনদ জমা দিতে পারিনি।’
এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল ১ ও ৭-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জুলকার নায়ন (উপসচিব) বলেন, ‘অনেক সময় অনেক জায়গা থেকে অযাচিত লোকজন ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়ে। এ কারণে শুধু আমার অঞ্চল নয়, উত্তরের প্রায় সব অঞ্চলেই কিছুদিন নিবন্ধন বন্ধ ছিল। এখন কিছুটা কাজ করা যাচ্ছে। বিষয়টি আমরা জন্ম ও মৃত্যু রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে জানিয়েছি। তারা কাজ করছে। আশা করছি, দ্রুত পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘নাগরিকরা বাইরে থেকে আবেদন করতে পারছে। আমাদের কাছে জমা দিলে কাজ শেষ করে আমরা যে প্রিন্ট করে ফাইনাল করে দেব, এতে সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় ওয়েবসাইটে ঢুকে প্রিন্ট করে দিতে পারছি না।’
ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-১০-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী জিয়াউল বাসেত (উপসচিব) বলেন, ‘এক মাস ধরে আমার অঞ্চলে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সেন্ট্রালি (রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়) বন্ধ রাখা হয়েছিল। আমাদের নতুন ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। গতকাল (৯ ফেব্রুয়ারি) থেকে কাজ করা যাচ্ছে।’
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্র জানা যায়, সারা দেশে ১২টি সিটি করপোরেশনের ১২৪টি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৩২৯টি পৌরসভা, চার হাজার ৫৭৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ১৫টি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং ৪৪টি দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৫৫টি দূতাবাস বা মিশনসহ প্রায় ছয় হাজার নিবন্ধন কার্যালয়ে সরাসরি ও নিয়মিত যোগাযোগ সমন্বয় করে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধনের কার্যক্রম চলছে। সম্প্রতি একই অফিশিয়াল ইউজার আইডি দিয়ে একাধিক ডিভাইস থেকে লগইন এবং জালিয়াতি করে জন্ম সনদ তৈরির কয়েকটি ঘটনার পর সিস্টেমের পরিবর্তন করে অফিশিয়াল ইউজারের মোবাইল নম্বরে একটি ওটিপি দিয়ে একটি ডিভাইস নিশ্চিত করার কাজ শুরু হয়। এ কারণে দোকান থেকে সাধারণ মানুষ কম্পিউটারের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করতে পারলেও এর প্রিন্ট নিতে পারেনি অনেক অফিশিয়াল ইউজার। আইডি-পাসওয়ার্ডজনিত এই সমস্যার কারণে তৃণমূল কার্যালয় কর্তৃপক্ষের অজ্ঞতাকে দায়ী করেছেন নিবন্ধন জেনারেল কার্যালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের উপরেজিস্ট্রার জেনারেল (যুগ্ম সচিব) মির্জা তারিক হিকমত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কাজ আমাদের না। ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরপোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট ও দূতাবাসের। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু সিস্টেমটাকে চালু রাখা। ২০১১ সালে কাজ শুরু হলেও আমাদের অফিস করা হয়েছে ২০১৬ সালে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই সিস্টেমের দেখভাল, যা খুব জরুরি। এ জন্য পর্যাপ্ত লোকবলও দরকার। অথচ এত বড় একটি সিস্টেম চালু রাখার জন্য আমাদের লোকবল মাত্র পাঁচ-ছয়জন।’
তিনি বলেন, ‘সবাই সমস্যার কথা বলে। কিন্তু সমস্যা সমাধানে আমাদের যে শক্তি প্রয়োজন, সেটা কেউ বলে না। ২১ কোটি ডাটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। যেখানে মাত্র একজন প্রগ্রামার কাজ করেন। আবার আমরা যখন অফিসগুলোতে একজনকে পাসওয়ার্ড দিই, তিনি যদি অন্য কাউকে তা শেয়ার করে দেন, সেটি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করব? তাই ওটিপি দিয়ে ইউজারনেম পাসওয়ার্ড আলাদা করা হচ্ছে। যারা নিশ্চিত করেনি, তাদেরই শুধু সার্ভারে ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে।’
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেল (মনিটরিং ও প্রশিক্ষণ) মো. আখতার জামিল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৩১ জানুয়ারি থেকে সার্ভারে পুরোদমে কাজ করা যাচ্ছে। ওয়েবসাইটের নোটিশ আপডেট করা হয়নি। তবে ওয়েবসাইট ঠিক হয়ে গেছে। সবাই নিবন্ধন করছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৪ বন্ধ রাখা হয়েছিল। তারা জানিয়েছিল হ্যাকড হয়েছে। পরে তাদের নিয়ে বসে সমাধান করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো বিভাগ বা জেলার কার্যক্রম বন্ধ নেই।’
ওয়েবসাইটের নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আগে এই ব্যবস্থা না থাকার কারণে একই ইউজার আইডি ব্যবহার করে অনেকে কাজ করত। মূল ব্যক্তি কাজ করছে কি না তা বোঝা যেত না। এখন একটা কম্পিউটার থেকে লগইন করা যাবে। একের অধিক ডিভাইসে কেউ ঢুকতে পারবে না। একটিতে লগইনের সুযোগ রেখে অন্য সব ডিভাইস থেকে লগআউট করে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য তারা এখন অভিযোগ জানাচ্ছে। যারা নতুন করে ওটিপি নিচ্ছে না, তারা লগইন করতে পারছে না। ইউজার হলে (অফিশিয়াল) ওটিপি দিয়ে লগইন করতে পারবে। আর নন-ইউজার হলেও আবেদন করতে পারবে যে কেউ।’
গত ৮ থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাঁচটি ওয়ার্ডের আইডি ব্যবহার করে সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে ৫৪৭টি জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের পক্ষ থেকে থানাগুলোতে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। পরে অনুসন্ধানে নামে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। জানা যায়, সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে চট্টগ্রামে পাঁচ হাজারেরও বেশি জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করেছে একটি হ্যাকার চক্র। এ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সোর্স : কালের কন্ঠ