দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার নতুন রেকর্ড হয়েছে আগেই। উৎপাদন বাড়ায় লোডশেডিংও কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার লোডশেডিং ফিরে এসেছে। গত মওসুমের শেষের দিকে তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। চলতি শীতের সময়েও লোডশেডিং হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় দিনে কয়েক ঘণ্টা করে হচ্ছে। এমন অবস্থায় সামনে গরমে লোডশেডিং নিয়ে চিন্তিত মানুষ। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রেকর্ড সক্ষমতার পরও কোনো এখন লোডশেডিং করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসাসের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময়ে ২০ শতাংশ স্পিনিং রিজার্ভ রাখতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ২২০ শতাংশ স্পিনিং রিজার্ভ কেন? বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, দেশে কোনো লোডশেডিং নেই।
বিজ্ঞাপন
চাহিদা অনুযায়ীই উৎপাদন হচ্ছে। বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনে সমস্যার কারণে মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে রাখতে হয়। সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদার তিন ভাগের প্রায় দুই ভাগ বিতরণ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এই ঘাটতি সমন্বয় করতে গিয়েই লোডশেডিং হচ্ছে। বিতরণ লাইনের সমস্যা কারণে সংকট আরও বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ বিভাগের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এখন প্রতিদিন বিদ্যুতের গড় চাহিদা সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট। গরমে গড়ে চাহিদা ১৪ হাজারের কিছু বেশি। এখন উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার মেগাওয়াট। এ হিসাব ঠিক থাকলে বিদ্যুতের ঘাটতি থাকার কথা নয়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বলছে, চাহিদার তুলনায় পিডিবি’র কাছ থেকে অনেক সময় বিদ্যুৎ পাচ্ছে না তারা।
তাদের বর্তমান গ্রাহক ৩ কোটি ৪২ লাখের কিছু বেশি। এই গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হলে প্রয়োজন প্রতিদিন সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু পিডিবি দিতে পারছে ৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি ৫০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট। এই ঘাটতি সমন্বয় করতে গিয়েই দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গরমে বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়তে পাবে। দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা এবং চাহিদার তুলনায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও কেন ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রসঙ্গে- পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমত উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, আমাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদানের সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি। আন্তর্জাতিক আইন অনুসাসের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময়ে ২০ শতাংশ স্পিনিং রিজার্ভ রাখতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ২২০ শতাংশ স্পিনিং রিজার্ভ কেন? অর্থাৎ যাদেরকে দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করানো হয়েছে, তারা যেন লুটেপুটে খেতে পারে। গত কয়েক বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা করে। সামনে ১২ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নেই। এখানে জোর দিতে হবে। পরিকল্পনা করে লাইন বসাতে হবে। জ্বালানি ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। গ্যাস উত্তোলনের ১২ নম্বর কূপে জোর দিতে হবে। মিয়ানমার তার কূপ থেকে গ্যাস নিয়ে আমাদের গ্যাসও চলে যাবে। সুতরাং আমরা বসে থাকলে চলবে না। কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম. শাসসুল আলম মানবজমিনকে বলেন, ডলার সংকট। কয়লা, তেল ও গ্যাস আনতে পারছে না সরকার।
বিদ্যুতের সক্ষমতা থাকলেও আসছে গরমে লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা করছেন এই বিশেষজ্ঞ। বিদ্যুতের আমদানির প্রয়োজন নেই। তবুও আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ নামে লুটপাট হচ্ছে। তিনি উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, গ্রাহকের জন্য ভালো কিছু দেখছি না। সক্ষমতা উন্নয়নে মান রক্ষা না হওয়ায় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণক্ষমতা পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ন্ত্রণে নেই। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে। ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের দোহাই দিয়ে সরকার অনেক কোম্পানিকে এ সুযোগ দিয়েছিল। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধারণাটি জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি। কোম্পানিগুলো থেকে সরকার উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনেছে। একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রেন্টাল, কুইক রেন্টালের নামে অসাধু ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে যাচ্ছে। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, গরমের সময় লোডশেডিং হওয়ার কোন কারণ নেই।
যদি জ্বালানিতে কোন সমস্যা না হয়। অনেক সময় আন্তর্জাতিক জাহাজ আসতে দেরি হলে সমস্যা হয়। তাছাড়া বৈদেশিক রিজার্ভে একটু সমস্যা আছে। বছরে ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা বিদ্যুৎকেন্দ্র করেন তাদেরে তেল ও ব্যবস্থাপনার খরচ আছে। সেটাতো নেবে। তিনি আরও বলেন, দেশে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার মেগাওয়াটের উপরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে আরও ৩ হাজার মেগাওয়াট যোগ করে হিসাব করতে হবে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। আরও এক হাজার মেগাওয়াট লস ধরা হবে। তাহলে সক্ষমতা অনুসারে ৭ থেকে ৮ হাজার মেগাওয়াট রিজার্ভ রয়েছে। পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনকালে গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মুজিব শতবর্ষে শতভাগ’ বিদ্যুৎ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, যার গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ। বর্তমানে ২০২৩ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। আর গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৪৩ লাখ।
সোর্স : মানবজমিন