কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেত্রীদের হাতে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী ক্যাম্পাসে যেতে চান। কিন্তু তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
আজ বুধবার সকালে ওই ছাত্রী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পাস থেকে ছাত্র উপদেষ্টা ফোন করে দেখা করতে বলেছেন। বলেছেন দুপুর ১২টায় যেতে। কিন্তু তিনি পাবনায় গ্রামের বাড়িতে আছেন। কীভাবে দেখা করবেন, বুঝতে পারছেন না। এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পর তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে গত রোববার রাতে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেছেন প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রী। ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা নির্যাতন চালিয়েছেন। নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল এবং এই ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই ছাত্রী গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, হলের প্রভোস্ট ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
সানজিদা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অপর অভিযুক্ত তাবাসসুম ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। ভুক্তভোগী ছাত্রীও একই বিভাগের।
ওই ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল তিনি বাবার সঙ্গে ক্যাম্পাসে যান। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় লিখিত অভিযোগ দিয়ে রাতেই পাবনায় ফেরেন। অসুস্থ থাকায় চিকিৎসক দেখিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়েছেন। ওষুধ খাচ্ছেন। ক্যাম্পাসে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত। তিনি আরও বলেন, ‘আমার তো ক্যাম্পাসে থাকার জায়গা নেই। কেউ এখন থাকতে দেবে কি না, সেটাও জানা নেই। ক্লাস না থাকলেও নতুন ভর্তি হওয়া অনেকেই ক্যাম্পাসে থেকে ঘুরছে। বিভাগে যাচ্ছে। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আমাকে এই মুহূর্তগুলো হারাতে হচ্ছে।’
এর আগে গতকাল দুপুরে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হল প্রভোস্ট, ছাত্র উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দপ্তরে পৃথকভাবে লিখিত অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। লিখিত অভিযোগে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী বলেন, গত বুধবার প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এ জন্য তিনি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক ছাত্রীর কাছে অতিথি হিসেবে ওঠেন। বৃহস্পতিবার তাবাসসুম নামের এক ছাত্রী তাঁর কক্ষে দেখা করতে যেতে বলেন। কিন্তু অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে দেখা করেননি তিনি। এর পর তাঁর ওপর চড়াও হন তাঁরা। পরে তাবাসসুমের কক্ষে গেলে ভয়ভীতি দেখান এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। তাঁরা বলতে থাকেন, তাঁদের না জানিয়ে কেন তিনি হলে উঠেছেন। শনিবার রাতে তাঁর ওপরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। রোববার বিকেলে প্রভোস্ট ও সহকারী প্রক্টরের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মীমাংসা হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘রোববার দিবাগত রাত ১১টার দিকে সানজিদা চৌধুরী ওরফে অন্তরাসহ সাত থেকে আটজন আমাকে একটি গণরুমে নিয়ে যান। সেখানে কথায় কথায় এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। আপনারা কেন মারছেন, বলতে গেলে ওনারা আমার মুখ চেপে ধরেন এবং সজোরে থাপ্পড় মারতে থাকেন। তাঁরা বলতে থাকেন, “চিনিস আমাদের, আমরা কত খারাপ? আমরা তোর কী করতে পারি জানিস তুই? কোনো আইডিয়া আছে আমাদের সম্পর্কে তোর?” পা ধরে মাফ চাইতে গেলে লাথি মারেন। আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। বুকের ওপর হাত দিয়ে জোরে থাবা মারেন এবং গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখেন। একপর্যায়ে তাঁরা একটা ময়লা গ্লাস তাঁকে দিয়ে চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেন এবং সেটার ভিডিও ধারণ করেন। তারপর তারা বলতে থাকেন, “জামা খোল”, জামা খুলতে না চাইলে তাঁরা আবার মারধর শুরু করেন এবং জোর করে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন।’
ভুক্তভোগী ছাত্রী অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, ভিডিওগুলো তাঁদের কাছে সংরক্ষণ করা। তাঁরা ভিডিও ধারণ করে বলেছেন, ‘যদি বাইরের কাউকে এ কথা বলিস, তাহলে তোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে দেব। যাতে তুই কাউকে মুখ দেখাতে না পারিস।’ সানজিদা বলেন, ‘তুই যদি প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দিস, তাহলে তোকে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব, যা বলেছি তা মনে থাকে যেন!’ নির্যাতন শেষে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে অন্য একটি গণরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সোমবার সকালে গ্রামের বাড়িতে চলে যান ভুক্তভোগী। এদিন সানজিদাসহ নির্যাতনে অংশ নেওয়া সবাই একাধিকবার ফোন দেন কিন্তু ভয়ে তিনি কারও ফোন ধরেননি। গতকাল সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন।
সোর্স : প্রথম আলো