ঢাকা
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১: ৪৭
এ জায়গায় সাধারণত রোগীর ভিড় থাকে। রেডিওথেরাপির যন্ত্র নষ্ট থাকায় গতকাল একজন রোগীও ছিল না। রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালেছবি: প্রথম আলো
দেশের সবচেয়ে বড় ক্যানসার হাসপাতালে রোগীরা রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা পাচ্ছে না। এই চিকিৎসার সব কটি যন্ত্র নষ্ট। কবে নাগাদ যন্ত্র ঠিক হবে, কবে নাগাদ নতুন যন্ত্র আসবে এবং কবে নাগাদ রোগীরা আবার রেডিওথেরাপি পাওয়া শুরু করবে, তা কর্তৃপক্ষই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। ঠিক সময়ে এই চিকিৎসা না পেলে কোনো কোনো ক্যানসার রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয় না।
সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে দেশে ক্যানসার চিকিৎসার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ৫০০ শয্যার এই সরকারি প্রতিষ্ঠানে সারা বছর ক্যানসার রোগীর ভিড় থাকে। প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১২০০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে। এখানে রোগীরা স্বল্প খরচে রেডিওথেরাপি নিতে পারে। এখন সেই সেবা পুরোপুরি বন্ধ।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেডিওথেরাপি চিকিৎসা আছে। সরকারের ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একটি করে যন্ত্র আছে। তবে বেসরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে এক দফা রেডিওথেরাপির খরচ দুই শ টাকা। বেসরকারি কোনো কোনো হাসপাতালে তা চার থেকে আট হাজার টাকা।
সেবা পরিস্থিতি
প্রতিষ্ঠানের পুরোনো বা মূল ভবনের নিচতলায় রেডিওথেরাপি নিতে আসা রোগীদের ভিড় থাকে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে সেই ভিড় দেখা যায়নি। সেখানে কথা হয় সিলেট থেকে আসা এক রোগীর সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর মা। তাঁর নাকে ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুয়ায়ী কেমোথেরাপি শেষ করেছেন। এখন রেডিওথেরাপির জন্য প্রতিদিন হাসপাতালে আসছেন। বুঝতে পারছেন না কত দিন এভাবে ঘুরতে হবে।
ওই ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক তাঁকে ২০ দফা রেডিওথেরাপি নিতে বলেছেন। এর মধ্যে তিনি গত সপ্তাহে এক দফা এই চিকিৎসা নিতে পেরেছেন। এর পর থেকে যন্ত্র নষ্ট।
ওই রোগীর মা হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেওয়ার আগাম অর্থ পরিশোধের রশিদ দেখিয়ে বলেন, তাঁরা দরিদ্র। রোগী তাঁর একমাত্র সন্তান। স্বামী কৃষিকাজ করেন। সন্তানের চিকিৎসায় ইতিমধ্যে সব সঞ্চয় শেষ। ঢাকায় বাসা ভাড়া করে আছেন। এখন ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।
শুধু সিলেটের এই রোগী নয়, আরও কয়েকজন রোগী বা তাদের সঙ্গে থাকা স্বজন একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। কেউ চিকিৎসা পাওয়ার অনিশ্চয়তায় আছেন, কেউ কত দিন ঢাকায় থাকবেন বা থেকে কোনো সেবা পাবেন কি না, তা বুঝে উঠতে পারছেন না। কর্তৃপক্ষও তাদের স্পষ্ট করে কিছু জানাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। বছরে মারা যায় প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার মানুষ। সংস্থাটি বলছে, মানসম্পন্ন সেবার জন্য প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি করে সমন্বিত ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার। সমন্বিত কেন্দ্রের অর্থ তাতে ক্যানসার শনাক্তের, ক্যানসার পরীক্ষার এবং চিকিৎসার সব ধরনের সুযোগ থাকবে। রোগীদের জন্য কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী দেশে ১৭০টি কেন্দ্র থাকা দরকার। কিন্তু আছে ৩৩টি। মহাখালীর এই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় তুলনামূলক কম বলে সারা দেশের দরিদ্র মানুষ এখানে আসে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালের করুণ অবস্থা বহু বছর ধরে চলছে। সমাজের প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি, কোনো বড় ব্যবসায়ী, আমলা বা রাজনীতিক এই হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য আসেন না।
এই হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাজ করে গত ডিসেম্বরে অবসরে গেছে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার। বর্তমানে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্যানসার রোগতত্ত্ব, প্রতিরোধ ও গবেষণা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। রেডিওথেরাপির সব কটি যন্ত্র অচল থাকা প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যানসার হাসপাতালের ইতিহাসে এটাই রেডিওথেরাপির সবচেয়ে বিপর্যন্ত পরিস্থিতি। সব যন্ত্র একসঙ্গে নষ্ট থাকবে, একজন রোগী সেবা পাবে না—এটা ভাবা যায় না। এমনিতেই রোগীদের সিরিয়াল পেতে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। এখন তা দেড় থেকে দুই বছরে দাঁড়াবে।’
বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রেডিওথেরাপি চিকিৎসা বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সব যন্ত্র নষ্ট
ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটা দাগে ক্যানসারের তিন ধরনের চিকিৎসা—কেমোথেরাপি বা ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা, রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা অর্থাৎ ক্যানসার কোষ বিশেষ আলোকরশ্মির মাধ্যমে মেরে ফেলা এবং অস্ত্রোপচার।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মূল রেডিওথেরাপি যন্ত্র আছে ছয়টি। এর মধ্যে চারটি লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর যন্ত্র (লাইনেক) এবং দুটি কোবাল্ট যন্ত্র। এ ছাড়া জরায়ু ক্যানসার চিকিৎসার জন্য একটি বেরাকিথেরাপি যন্ত্র আছে।
ক্যানসার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. নিজামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুটি লাইনেক ও দুটি কোবাল্ট যন্ত্র একেবারে নষ্ট। সরকার যন্ত্র চারটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। অন্য একটি লাইনেক মেরামতের জন্য পড়ে আছে। বাকি লাইনেক যন্ত্রটি দু–এক দিন আগে নষ্ট হয়েছে। চালু করার জন্য প্রকৌশলীরা চেষ্টা করছেন।
সর্বশেষ যন্ত্রটি কীভাবে নষ্ট হলো, তা নিয়ে নানা কথা শোনা গেছে। হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বৈদ্যুতিক লাইন নষ্ট হওয়ায় যন্ত্রটি চালানো যাচ্ছে না। রোগীরা বলেছেন, তাঁরা শুনেছেন যে ইঁদুর যন্ত্রের তার কেটে দিয়েছে। এ ব্যাপারে পরিচালক অধ্যাপক মো. নিজামুল হক বলেন, ‘ইঁদুর যন্ত্রের তার কেটেছে, এটা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি।’
অনিশ্চিত সেবা
অধ্যাপক মো. নিজামুল হক জানিয়েছেন, সব কটি যন্ত্র চালু থাকলে এই হাসপাতালে দৈনিক গড়ে সাত শতাধিক মানুষকে রেডিওথেরাপি দেওয়া সম্ভব, অতীতে দেওয়া হয়েছে।
এখন একজনও সেবা পাচ্ছে না। কবে নাগাদ সেবা চালু করতে পারবেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে পরিচালক বলেন, ‘একটি যন্ত্র শিগগিরই চালু করতে পারব বলে আশা করি। অন্যদিকে এই বছরের মধ্যে একটি যন্ত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও একটি যন্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
বাস্তবে এসব যন্ত্র কবে কেনা হবে, সেই যন্ত্রে কবে মানুষ সেবা পাবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেছেন না। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় বলছি, এসব নতুন যন্ত্রে সেবা শুরু করতে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই বছর লাগবে।’
সেবা বন্ধ রাখার বিষয়টি কর্তৃপক্ষ গোপন করেনি, বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। যে ভবনের নিচতলা রেডিওথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানকার দেয়ালে সাঁটানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে: যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বর্তমানে রেডিওথেরাপি চিকিৎসাসেবা প্রদান করা সম্ভব হইতেছে না। পরবর্তী চিকিৎসাসেবা পাওয়ার জন্য নিম্নলিখিত ফোন নম্বরে (অফিস টাইমে) যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হইল। ফোন নম্বার: ০২২২২২৮০০৭৮।
গতকাল বেলা পৌনে দুইটায় এই প্রতিবেদক হাসপাতালের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন। অন্য প্রান্ত থেকে বলা হয়, হাসপাতালে সব ধরনের রেডিওথেরাপি সেবা বন্ধ। সেবা কবে চালু হবে, তা তিনি জানেন না। সেবার ব্যাপারে জানতে তিনি আবার ফোন করতে বলেন।
গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে পড়ে থাকা বা নষ্ট হওয়া যন্ত্র চালু করার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ক্যানসার হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মাত্র কয়েক শ গজ দূরে। ক্যানসার হাসপাতালের যন্ত্রের ব্যাপারে অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। গতকাল এই প্রতিবেদক অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মতামত নেওয়ার জন্য তাঁর দপ্তরে গিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, মহাপরিচালক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ক্যানসার চিকিৎসায় জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের চরম উদাসীনতার কারণে জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি এ অবস্থায় পড়েছে। মন্ত্রী ও মহাপরিচালক যদি আন্তরিক থাকতেন, তা হলে এই অবস্থা হতো না। এটা দায়িত্বহীনতা ও জবাবদিহির ঘাটতির নজির।’
সোর্স : প্রথম আলো