বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের একটি হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ২০০৭-০৮ সালের পূর্ববর্তী সরকারের ব্যর্থতার বড় আলোচনার ক্ষেত্র ছিল এটি। জ্বালানি বিশেষত গ্যাস খাতের ব্যবস্থাপনা বা গ্যাস সরবরাহ তখনো বড় কোনো সঙ্কট হিসাবে দেখা দেয়নি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেয় বিদ্যুৎ খাতের ওপর। দ্রুত বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য অতি উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সাথে একের পর এক চুক্তি করা হয়। এর জন্য প্রথমে ২০১০ সালে এবং এরপর ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ খাতের নতুন মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এই মহাপরিকল্পনার আলোকে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বিন্যাস করা হয়। কিন্তু এই মহাপরিকল্পনার সাথে বাস্তবতার মিল কমই পাওয়া গেছে।
২০১৬ সালের সর্বশেষ মহাপরিকল্পনা অনুসারে ২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা ২৪ হাজার মেগাওয়াট। বাস্তবে সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পিক সময়ে ১০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট আর দিনের বেলা অফপিক সময়ে আট হাজার ৯৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। অথচ এই ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আর বাস্তবে যখন সে চাহিদা নেই তখন বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদকদের। আর এর দায় যাতে সরকারের কর্মকর্তাদের নিতে না হয় তার জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পর্যায়ক্রমে দায়মুক্তি দিয়ে এক দিকে এ জন্য আইনিভাবে চ্যালেঞ্জ না করার বিধান করা হয়, অন্য দিকে ক্রয়চুক্তিগুলো রাখা হয় একেবারেই গোপন।
এর ফলে বেসরকারি খাত থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের এসব চুক্তি জাতির জন্য কতটা মঙ্গলজনক তা খোলামেলা পর্যালোচনা করার অবকাশ থাকেনি। এর মধ্যেও অতি উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন উত্থাপন করলে সেটি এড়ানোর জন্য যুক্তি দেখানো হয় যে, বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠান বা গৃহস্থালি ভোক্তারা লোডশেডিংকালে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য যে খরচ করে তার চেয়ে রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়ে সরবরাহের যে খরচ পড়বে তা হবে কম। এই যুক্তি অনেকাংশে সত্য হলেও এই প্রশ্ন থেকে যায় যে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জরুরি বা স্বাভাবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে খরচ কম হচ্ছে সেখানে কেন বেসরকারি খাত থেকে বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কেনা হবে? এর জবাবে বলা হয়, বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নেই। এই যুক্তিটি পূর্ববর্তী সরকারের আমল থেকেই দিয়ে আসা হচ্ছিল। অথচ বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেনার জন্য যে অর্থ প্রতি বছর খরচ করা হয় সে অর্থ জরুরি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় করা হলে অনেক সাশ্রয়ীমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যেত। একই সাথে সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকত রাষ্ট্রের মালিকানায় সরকারের হাতে।
সুুবিধা দেয়ার ফর্মুলা
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের দু’টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমলে না নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক বিদ্যুৎ খাতে। সারা দিনের বিদ্যুৎচাহিদা বাংলাদেশে একই মাত্রায় থাকে না। সন্ধ্যার পর দুই থেকে তিন ঘণ্টা চাহিদা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে যায়। আর রাতের শেষ দিকে শিল্প-কারখানাগুলোর অফপিক সময়ে চাহিদা কমে যায়। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত যখন সরকারি উৎপাদননির্ভর ছিল তখন জ্বালানি তেলভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল যেগুলো অফপিক সময়ে বন্ধ রেখে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় চালু রাখা হতো। এতে গড় বিদ্যুৎপ্রাপ্তি খরচের ওপর বড়ভাবে প্রভাব পড়ত না।
কিন্তু নব্বই দশক থেকে বেসরকারি উৎপাদকের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হওয়ার পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এসব বিদ্যুৎ উৎপাদকের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে একটিতে থাকে তাদের উৎপাদনসক্ষমতা বা প্লান্টের ভাড়া। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কোনো বিদ্যুৎ না নেয়া হলেও নির্ধারিত এই ভাড়া সরকারকে দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে লোড ফ্যাক্টর বিবেচনায় আনা হয়। অর্থাৎ কোনো প্লান্টে যে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে তার ৫০, ৬০ বা ৭০ শতাংশ ক্ষমতার সমপরিমাণ বিদ্যুতের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। আর বিদ্যুৎ কেনার জন্য মূল্য ঠিক হয় এর উপাদান হিসাবে গ্যাস, কয়লা বা ডিজেল যেটি ব্যবহার হবে তার মূল্যের সাথে প্রাসঙ্গিক অন্য খরচ যোগ করার পর।
এখানে সরকারের সাথে একবার চুক্তি করা হলে বিনিয়োগের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোক্তার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারলে আসে বাড়তি মুনাফা। কিন্তু রাষ্ট্রের যে সঙ্কট সেটি হলো বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিদ্যুৎপ্রাপ্তির গড় খরচ বেড়ে যায়। আর এর চাপে বাড়াতে হচ্ছে বিদ্যুতের বিক্রি মূল্য, যা বহন করতে হয় গ্রাহকদের। ব্যয়বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল গড়ে তিন টাকা ৯৫ পয়সা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৩৬ পয়সা। ২০২০-২১ অর্থবছর তা বেড়ে হয় ছয় টাকা ৬১ পয়সা আর ২০২১-২২ অর্থবছর হয় ৮ টাকা ৮৪ পয়সা। এ সময় সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কর্তৃপক্ষ এ সময়ে বিদ্যুৎ পেয়েছে প্রতি কিলোওয়াট পৌনে পাঁচ টাকা দরে। পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এ সময় বিদ্যুৎ কিনতে হয় ৫.০২ টাকা দরে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে একই সময়ে কেনা হয়েছে ১১.৫৫ টাকা দরে। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নেয়া হয়েছে ৯.৮০ পয়সা দরে। ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে ৬.১১ টাকা দরে। এতে সরকারের গড় বিদ্যুৎ খরচ পড়েছে ৮.৮৪ টাকা। অথচ ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে যে চুক্তি করা হয়েছে সেটি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে ১৭ টাকা দরে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়বৃদ্ধির এ ধাক্কা ভর্তুকি দিয়ে পুরোটা মেটানো যায়নি। এজন্য বাল্ক (পাইকারি) পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১২ বছরে ৯ বার। আবার বাল্ক মূল্যহার বাড়ানোয় লোকসানে পড়ে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো। এতে গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১২ বছরে ৯ বার। এখন কয়েক সপ্তাহ পরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির চাপ শেষ পর্যন্ত জনগণের ঘাড়ে এসে পড়ছে।
রাষ্ট্রের সাথে কোনো কোনো বেসরকারি গ্রুপের করা চুক্তি অনুসারে সাশ্রয়ীমূল্যে অর্থাৎ সরকারি খরচের কাছাকাছি দামে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম পড়ে যায় তিনগুণ পর্যন্ত। এতে বেসরকারি খাতের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড়প্রাপ্তি দাঁড়ায় সাড়ে ১১ টাকা। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎপ্রাপ্তির হার মূল্য একসময় অনেক বেশি ছিল। এখন সেটি কিছুটা কমে এসেছে ব্যয়বহুল কিছু চুক্তির নবায়ন না করার কারণে। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সাথে প্রথমে দুই-তিন বছরের জন্য ক্রয়চুক্তি করা হয়। পরে এগুলোর কোনো কোনোটা ১২-১৩ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।
আদানির জন্য রক্তক্ষরণ
এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে যে বাড়তি অর্থ সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি জাতীয় সম্পদের রক্তক্ষরণ হওয়ার মতো চুক্তি করা হয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন গোড্ডা পাওয়ারের সাথে। ২৫ বছর ধরে এই রাষ্ট্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে যদি কোনো বিদ্যুৎ নাও নেয়া হয়।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আদানি ওয়াচ বাংলাদেশের সাথে যে বিদ্যুৎ চুক্তি করা হয়েছে তার বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আদানি পাওয়ারের কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলেছে। যদিও তাদের সব প্রশ্নের জবাব কর্তৃপক্ষ দেয়নি।
ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৭ সালে সরকার এই চুক্তি করেছে। চলমান বিদ্যুৎ সঙ্কট থেকে উত্তরণে সরকার এই বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করছে বলে উল্লেখ করা হলেও আদানি ওয়াচ ও যুক্তরাষ্ট্রের হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভিন্ন কিছু। আদানি ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার দাম বেশি পড়বে, যা দিতে হবে বাংলাদেশকে। এ ছাড়া ভারতের উচ্চ করপোরেট ট্যাক্স, কয়লার পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় এই বিদ্যুতের দাম দেশের অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি হবে। ভারত থেকে আমদানি করা অন্য বিদ্যুতের চেয়ে তিন গুণ আর পায়রা কেন্দ্রের চেয়ে দ্বিগুণ দাম হবে আদানির বিদ্যুতের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির জন্য কেন্দ্রটি নির্মাণ প্রায় শেষ করেছে আদানি গ্রুপ। সেখান থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০৬ কিলোমিটার ও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে জাতীয় গ্রিড পর্যন্ত আরো প্রায় ৩০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের কমিশনিং সম্পন্ন হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করছে আদানি। এখন ২০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ আসছে। এই কেন্দ্র থেকে এক হাজার ৩৪৪ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
আদানি ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি বিশ্লেষণ করে ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম যত বেশিই হোক না কেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড় পায় বাংলাদেশ। কিন্তু আদানির সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ কয়লার দাম আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী দিতে হবে। আদানির অস্ট্রেলীয় কয়লা খনি থেকে এই কয়লার সরবরাহ আসায় এর মূল্য ঠিক করবে আদানি নিজে। এতে জ্বালানি খরচ বেশি পড়বে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি ভারতে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালায়, এগুলো অধিকাংশই সমুদ্রের কাছে; যাতে সড়ক অথবা রেলে কয়লা পরিবহনের খরচ কমানো যায়। কিন্তু গোড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্দর থেকে বেশি দূরে হওয়ায় কয়লা পরিবহনে বাড়তি ব্যয় বিদ্যুতের দাম বাড়াবে। এতে আদানির ব্যবসা হলেও বাংলাদেশের জন্য তা বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এতে আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৬-১৭ টাকায় কিনতে হবে বাংলাদেশকে। যদিও আমদানি করা কয়লা দিয়ে উৎপাদিত পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ৮-৯ টাকা।
অন্য বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির ক্যাপাসিটি চার্জও বেশি। বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন দি এক্সটার্নাল ডেট ও ভারতভিত্তিক গ্রোথওয়াচের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ নেয়া না গেলে এর বিপরীতে বড় অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে বাংলাদেশকে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বার্ষিক ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪২ কোটি ৩২ লাখ ৯০ হাজার ডলারে। টাকার অঙ্কে যা দাঁড়াবে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো। ২৫ বছর ধরে এভাবে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হলে লক্ষ কোটি টাকা দাঁড়াবে। যা হবে প্লান্টের খরচের প্রায় চার গুণের সমান।
ক্যাপাসিটি চার্জের খড়গ
পিডিবির তথ্য অনুসারে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১৪ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় প্রায় ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের সমান অর্থ গেছে এ খাতে। যদিও এ সময় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হয়নি। এমনকি কোনো কোনো বছর সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। অথচ বসিয়ে রেখেই প্রতি বছরই ক্যাপাসিটি চার্জের পুরোটা পরিশোধ করা হয়।
২০০৮-০৯ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছর তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ আরো বেড়ে হয় দুুই হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা এক লাফে পাঁচ হাজার কোটি টাকায় ওঠে। এরপর কয়েক বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার ঘরেই ছিল। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় পৌনে ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ তা অনেকটাই বেড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছায়। ২০২০-২১ অর্থবছর তা আরো বেড়ে অতিক্রম করে ১৩ হাজার কোটি টাকা। আর সর্বশেষ অর্থবছর (২০২১-২২) তা দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জের বৃদ্ধির এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে প্রাক্কলন করেছে পিডিবি। চলতি অর্থবছর তা ১৫ হাজার কোটি টাকা ছুঁতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ১৪ বছরে সামিটের পকেটে ক্যাপাসিটি চার্জ ঢুকেছে প্রায় ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ১২ শতাংশ। ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। গত ১৪ বছরে কোম্পানিটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে সাত হাজার ৯৩২ কোটি টাকা, যা এ খাতে ব্যয়ের প্রায় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মালয়েশিয়াভিত্তিক চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংসের। ১৪ বছরে এরদা পাওয়ার ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে সাত হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, যা এ খাতে ব্যয়ের ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে সার্বিকভাবে চতুর্থ তবে দেশীয় কোম্পানির মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপ। সব মিলিয়ে ১৪ বছরে গ্রুপটি ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পরের পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। ১৪ বছরে এ কোম্পানির পকেটে গেছে পাঁচ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।
সর্বব্যাপী সঙ্কট
বাংলাদেশ এখন নজিরবিহীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কটে রয়েছে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের পর এই সঙ্কট বেড়েছে। একসময় জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে কম থাকায় আমদানি করা এলএনজি বা তেল দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরিতে বড় কোনো সঙ্কট দেখা দেয়নি। সাত ডলার থেকে ১১-১২ ডলারে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি পাওয়া গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর এর দাম পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। যার ফলে এলএনজি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়ে আবারো ব্যাপক লোডশেডিং শুরু হয়েছে।
এই চাপের কারণে কয়েক সপ্তাহ পরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো শুরু হয়েছে। গ্যাসের দাম শিল্পকারখানার জন্য পৌনে ২০০ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ক্যাপটিভ পাওয়ারের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৮৮ শতাংশ। এই বিপুল মূল্যবৃদ্ধির পরও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে যে অরাজক ধরনের অবস্থা দেখা দিয়েছে তা সামাল দিতে পারছে না শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা। তৈরী পোশাক ও এর অনেক লিংকেজ শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিনই খবর আসছে শ্রমিকদের বেতন ভাতার জন্য ভাঙচুরের ঘটনার।
এ অবস্থা কোনোভাবেই চলতে পারে না। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা এখনি ভাবতে হবে। প্রথমত, আদানির গোড্ডা পাওয়ারের মতো যেসব প্রকল্প দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে সেগুলোকে নিয়ে নতুন করে দর কষাকষির মাধ্যমে শর্ত পুনর্নির্ধারণ বা প্রকল্প বাতিলে পদক্ষেপ নেয়া, দ্বিতীয়ত, ব্যয়বহুল রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্রকল্পের মেয়াদ আর না বাড়ানো। তৃতীয়ত, বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনের সক্ষমতা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ নেয়া। চতুর্থত, সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে স্থল ও সমুদ্র ভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কাজকে চাঙ্গা করা, অভ্যন্তরীণ উৎসের কয়লা ব্যবহার করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো, যাতে সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। পঞ্চমত, বিদ্যুতের আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো। ষষ্ঠত, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব ধরনের দায়মুক্তির অবসান ঘটানো।
রাষ্ট্রের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা এমন একটি বিষয়, যার ওপর সামরিক ও ভৌগোলিক নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই সংবেদনশীল খাতে অর্থনৈতিক ও সার্বিক জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিষয় বিবেচনা করা দরকার। গত এক দশকে এর ব্যাপক ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। যার ফলে বিদ্যুৎ খাতে এক ধরনের অরাজক অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সাথে জনজীবনেও বিপর্যয় নামার বিপর্যয়কর সঙ্কেত বেজে উঠতে পারে।
mrkmmb@gmail.com
সোর্স : নয়া দিগন্ত