হজের ব্যয় দিন দিন আকাশচুম্বী হচ্ছে। হজের টাকা যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন হজযাত্রীরা। সউদী আরবে হজে ব্যয় কমলেও বাংলাদেশে ব্যয় বৃদ্ধির দরুন অনেক সাধারণ মানুষ হজ পালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের হজ প্যাকেজের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ডলার সঙ্কটের মাঝে সউদী রিয়ালের বিনিময় হার গত বছরের চেয়ে এবার হজ প্যাকেজে প্রায় ৬৪ হাজার টাকা বাড়ছে। গত বছরের তুলনায় শুধু বিমান ভাড়াই বেড়েছে ৫৭ হাজার টাকা। এতে অনেক হজযাত্রী হজ পালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবার হজযাত্রী রিপ্রেসমেন্ট কার্যক্রম বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়ায় হজে গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের মাঝে শঙ্কা বিরাজ করছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিচ (হজ) মহিতুল ইসলাম গতকাল সোমবার বলেছেন, রিয়ালের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এবার হজ প্যাকেজের মূল্য বেড়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত সচিব বলেন, সউদী সরকার হজের ব্যয় এবার কমিয়েছে। মিনারে তাঁবু ভাড়া কমিয়েছে। শুধু জমজম পানির দাম ১২ রিয়ালের স্থলে এবার ৩ রিয়াল বাড়িয়ে ১৫ রিয়াল করেছে। ২০২২ সালে রুট টু মক্কা ইনিশিয়েটিভ এর অধীনে হাজীদের ল্যাগেজ পরিবহনে ব্যয় ধরা হয়নি। এবার রুট টু মক্কা ইনিশিয়েটিভ হাজীদের ল্যাগেজ পরিবহনে ২০ দশমিক ৭০ রিয়াল ব্যয় ধরা হয়েছে। হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত সচিব (হজ) মহিতুল ইসলাম বলেন, হাজীদের বিমান ভাড়ার বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারের বাইরে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় হাজীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণ করে। সেখানে আমাদের করার কিছু থাকে না। ২০২২ সালের হজ প্যাকেজে রিয়ালের বিনিময় হার ধরা হয়েছিল ২৪ টাকা ৩০ পয়সা। এবার হজ প্যাকেজে রিয়ালের বিনিময় হার ধরা হয়েছে ২৮ টাকা ৩৯ পয়সা। এতে গত বারের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৬৪ হাজার টাকা।
বিগত সাত বছরের উল্লেখযোগ্য হারে হজের খরচ বেড়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুসারে ২০১৫ সালে হজের জন্য সর্বনিম্ন খরচ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকার। ২০১৮ সালে ছিল ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিবেচনায় নিলে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর গত বছরের তুলনায় ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। অথচ এবার সউদী সরকার হজে আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। অনেক হজযাত্রী হজে যাওয়ার চ‚ড়ান্ত নিবন্ধনে সাড়া দিচ্ছে না। হজের নিবন্ধন কার্যক্রমেও চলছে ধীরগতি। গতকাল পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ হাজার ৩৫৯ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩৫৬ জন চ‚ড়ান্ত নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। হজের টাকা যোগাড় করতে না পারায় অনেকেই নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক হজ এজেন্সির মালিক এতথ্য জানিয়েছেন। সউদ-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক হজ চুক্তি অনুযায়ী এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮জন হজে যাওয়ার কথা। আটাবের ইভিপি ও হজযাত্রী কল্যাণ সংস্থা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আলহাজ এইচ এম মুজিবুল হক শাকুর গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি করোনা পরবর্তী সময়ে মানুষের যখন ত্রাহি অবস্থা ঠিক তখনই বিমান ভাড়াসহ হজের খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে হজযাত্রীদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে হজের খরব এত বাড়ানো হয়নি। তিনি হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া ৫০ হাজার টাকা কমিয়ে হজ প্যাকেজ পুনঃনির্ধারণের দাবি জানান। তিনি বলেন, হজের টাকা যোগাতে না পেরে অনেকেই হজের নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারছেন না। এইব এম মুজিবুল হক শাকুর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, হজ প্যাকেজের খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য হজ পালন এখন স্বপ্নের বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। এতো টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষের পক্ষে হজে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তিনি বলেন, অনেকেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে বা শেষ বয়সে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে হজে যান। হজের খরচ বাড়ার কারণে অনেকেই ওমরার দিকে আগ্রহী হচ্ছেন। কারণ এতো অর্থ ব্যয় করে সাধারণের পক্ষে হজে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
হজযাত্রীদের বিমান ভাড়াও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ২০২২ সালের হজে যাত্রীদের বিমান ভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার হজের প্যাকেজে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। ২০২২ সালে হজের প্যাকেজ মূল্য ছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। এবার হজ প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এতে অনেক প্রাক-নিবন্ধিত হজযাত্রী ব্যয় বৃদ্ধির কারণে চ‚ড়ান্ত নিবন্ধন না করে হজে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ বলছেন, এতো টাকা দিয়ে হজে যাওয়ার সামর্থ নেই। বিধায় আমরা ওমরাহ পালন করব। আটাবের মহাসচিব আব্দুস সালাম আরেফ গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, চলতি বছরের হজ প্যাকেজের উচ্চ মূল্য বৃদ্ধিতে আমরা হতবাক। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও হজের ব্যয় এতো বাড়েনি। আটাব মহাসচিব বলেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। একই বছর ভারতের হজ প্যাকেজ ছিল বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ লাখ ৭৬৩ টাকা আর পাকিস্তানের হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ লাখ ৩১ হাজার ৭৫২ টাকা। চলতি বছর বাংলাদেশি টাকায় ভারতের হজ প্যাকেজ মূল্য হচ্ছে প্রায় ৫ লাখ ১৫ হাজার ৮৪৬ টাকা আর পাকিস্তানের হজ প্যাকেজ মূল্য হচ্ছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৯৭২ টাকা। আর বাংলাদেশের হজ প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা (কোরবানি বাদে)। এর মধ্যে বিমান ভাড়াই ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
আটাব মহাসচিব আরেফ বলেন, হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারনী সভায় আটাবের নেতাদের ডাকা হয়নি। হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে হাবের জোড়ালো কোনো ভ‚মিকা ছিল না বলে তিনি দাবি করেন। তিনি হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় পুনঃনির্ধারণের জোর দাবি জানান। হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ডলার ও রিয়ালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে হজ প্যাকেজের ব্যয় বাড়ছে। হাব সভাপতি বলেন, বিমান কর্তৃপক্ষ গত ২৩ জানুয়ারি হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া জনপ্রতি ২ লাখ ১০ হাজার ৩৩৭ টাকা নির্ধারণ করেছিল। চলতি বছর বিমান মন্ত্রণালয় অযৌক্তিকভাবে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া বাড়িয়েছে। হাবের প্রতিবাদের কারণেই বিমান ভাড়া ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে। তাতেও আমরা সন্তুষ্ট নই। বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। তার পরেও বিমান ভাড়া আরো অনেক কম হওয়া উচিত ছিল। হাব সভাপতি বলেন, হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সাথে হাবের কোনো লাভ লস নেই। অতিরিক্ত বিমান ভাড়ার বৈঠকে দু’দফা ওয়াক আউট করেছেন বলেও হাব সভাপতি উল্লেখ করেন। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণের বৈঠকে আটাব সভাপতি ও মহাসচিব উপস্থিত থেকে কোনো প্রতিবাদ করেননি বলেও হাব সভাপতি দাবি করেন। হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া কমানো হলে হজ প্যাকেজের খরচ আরো কমতো বলে হাব সভাপতি তসলিম অভিমত ব্যক্ত করেন।
হজ করতে এবার কোরবানিসহ প্রায় ৭ লাখ টাকার মতো খরচ হবে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা ব্যয় হবে। গত জানুয়ারি মাসেও ১৫ দিনের ওমরাহ প্যাকেজের খরচ ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা। এই টাকায় বিমানভাড়া, মক্কা-মদিনায় আবাসন, মক্কা-মদিনা যাতায়াত ও খাবার যুক্ত ছিল। আটাবের উপদেষ্টা গোলাম মাহমুদ ভ‚ঁইয়া বলেন, এবারের হজ প্যাকেজে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার। ফলে হজ পালনও সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিমান ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়েনি। অথচ হজযাত্রীদের অযৌক্তিক বিমান ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এতে অনেকেই হজ পালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তিনি বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে কমানোর জোর দাবি জানান।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ ও ২০০২ সালে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের জনপ্রতি বিমান ভাড়া ছিল ৭৫০ মার্কিন ডলার (নীট), ২০০৩ সালে হজযাত্রীদের ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় জনপ্রতি ৮৭০ ডলার (নীট), ২০০৪ সালে আগের বছরের চেয়ে ৩০ ডলার বেড়ে ভাড়া দাঁড়ায় ৯শ’ ডলার (নীট), ২০০৫ সালে বিমান ভাড়া ৯৫০ ডলার (নীট), ২০০৬ সালের জানুয়ারির বিমান ভাড়া ১০৫০ ডলার (নীট) এবং ডিসেম্বরের হজে বিমান ভাড়া ছিল ১২০০ ডলার (নীট), ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ১২৫০ ডলার (নীট), ২০০৯ সালে ১৩০০ ডলার (নীট), ২০১০ সালে ১৩৫০ ডলার (নীট), ২০১১ সালে ১৪৬৫ ডলার (নীট), ২০১২ ও ২০১৩ সালে ১৪৭৫ ডলার (নীট), ২০১৪ সালে ১৫০০ ডলার (নীট), ২০১৫ সালে ১৫২৫ ডলার (নীট), ২০১৬ সালে ১৪৫০ ডলার (নীট), ২০১৭ সালে ১৫০০ ডলার (নীট), ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ১৫৫০ ডলার (নীট) এবং ২০২২ সালে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া ছিল ১৫৫৫ মার্কিন ডলার (নীট)। আর এবার এক লাফেই হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া জনপ্রতি ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সোর্স : ইনকিলাব