মাধ্যমিক স্তরে গণিত এবং ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করেন প্রায় ৮৩ (৮২ দশমিক ৫) শতাংশ অন্য বিষয়ের ডিগ্রিধারী শিক্ষক। এরমধ্যে গণিতে ৮১ ও ইংরেজিতে ৮৪ শতাংশ শিক্ষক রয়েছেন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ২০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ের কোনো শিক্ষক নেই। আর মালটিমিডিয়ার ব্যবস্থা নেই ২০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। সরকারি এবং বেসরকারি একাধিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমন চিত্র।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শিক্ষক ঘাটতির কারণে ছাত্রছাত্রীরা উল্লিখিত তিন বিষয়ে প্রয়োজনীয়তা দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। যারা দক্ষতা অর্জন করতে চায় তাদের প্রাইভেট-কোচিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আর যাদের কোচিংয়ের পেছনে অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য নেই তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সাধারণত গণিত এবং ইংরেজি কঠিন বিষয় হিসাবে চিহ্নিত। তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক থাকায় আইসিটি বিষয়টিও তুলনামূলক কঠিন। পাবলিক পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের বেশিরভাগ ইংরেজি ও গণিতের বাধা পার হতে পারছে না। আংশিক সিলেবাসে পরীক্ষা দেওয়ার পরও বিগত (২০২২ সাল) এসএসসি পরীক্ষায় গড়ে ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। আর ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষায় ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছে।
জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এভাবে অন্য বিষয়ের শিক্ষক দ্বারা ইংরেজির মতো ভাষা জ্ঞানের পাঠদান কিংবা গণিত ও আইসিটিতে দক্ষতা প্রদানের মাধ্যমে মূলত শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। জনশক্তিকে শুধু বিসিএস আর সরকারি কিছু চাকরির জন্য গড়ে তোলা কোনো লক্ষ্য হতে পারে না। বর্তমানে দেশের কর্মজগতেও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। নইলে বিভিন্ন জাতীয় বা বহুজাতিক কোম্পানির ‘সুপার ম্যানেজারিয়াল’ (উচ্চতর ব্যবস্থাপনার কাজ) পদে ভারত-শ্রীলংকাসহ অন্য দেশের কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা লাগত না। দক্ষ জনবলের অভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা কর্মীদের প্রতিবছর ৬ বিলিয়ন ডলার বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। বেতন-ভাতা ও সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়ে সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবছর তথ্যগত পরিসংখ্যান ও সমীক্ষা প্রকাশ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। প্রতিষ্ঠানটির ‘বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন ৯৬ হাজার ৫৮ জন। এর মধ্যে ৯ হাজার ২৮২ জন শিক্ষক শুধু ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। এটা মোট শিক্ষকের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ। তাদের মধ্যে আবার ৬ হাজার ২৪১ জন শিক্ষকের ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে, এইচএসসি পাশ করা ৩ হাজার ৮৫৭ জন ক্লাসে ইংরেজি পড়ান। বাকিদের স্নাতক ডিগ্রি থাকলেও কেউ স্নাতক হওয়ার জন্য ১০০ বা ৩০০ নম্বরের ইংরেজি পড়ে এসেছেন। এই সমীক্ষা অনুযায়ী, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের পড়ানো শিক্ষকদের ৮৪ শতাংশেরই এ বিষয়ে ডিগ্রি নেই।
ওই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক ৬৭ হাজার ৯৫৫ জন। এরমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ১৩ হাজার ১২৭ জন। তাদের মধ্যে গণিতে শুধু স্নাতক আছে কিন্তু স্নাতকোত্তর করেননি এমন আছেন ৫ হাজার ৮৪৩ জন। বাকি ৭ হাজার ২৮৫ শিক্ষক গণিতে স্নাতকোত্তর আছে কিন্তু স্নাতক করেছেন কিনা তা জানা যায়নি। এই হিসাবে গণিতে ডিগ্রিধারী আছেন শুধু ১৯ শতাংশ শিক্ষক। এ ক্ষেত্রে হতাশাজনক তথ্য হচ্ছে, এসএসসির পর কোনোদিন গণিত পড়েননি এমন শিক্ষক আছেন ৮২৫৮ জন যা মোট শিক্ষকের ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ। আর অন্য বিষয়ে স্নাতক কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে গণিত পড়ে এসেছেন এমন আছেন ১৬২৫৬ জন, যা প্রায় ২৪ শতাংশ। সবমিলে গণিতে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি না থাকা শিক্ষকের হার ৮১ শতাংশ।
শুধু গণিত বা ইংরেজি নয়, আইসিটি বিষয়েও জোড়াতালি দিয়ে পাঠদান চলছে। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মোট ২০ হাজার ২৯৪ সরকারি-বেসরকারি স্কুলের মধ্যে ১৬ হাজার ২৭৫টিতে আইসিটি শিক্ষক আছেন। এটা মোট সংখ্যার ৮০ শতাংশ। বাকি ২০ শতাংশ স্কুলে অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা পাঠদান করে থাকেন। সূত্র জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে-৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে আইসিটির শিক্ষক আছেন, তাদের মধ্যে বড় একটা সংখ্যা কম্পিউটারে নামেমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিংবা ডিপ্লোমাধারী। অনেকেই জাল সনদধারী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) যত জাল সনদ ধরেছে, তার অর্ধেকের মতোই এই বিষয়ের শিক্ষক। বাকিরা নিবন্ধন সনদ বা অন্য একাডেমিক জাল সনদধারী শিক্ষক। আইসিটি শিক্ষকদের মধ্যে স্নাতকধারী খুব কমই আছেন।
শিক্ষক নেতারা বলছেন, ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে ২০২১ সালের তথ্য আছে। গত এক বছরে বেশকিছু শিক্ষক অবসরে গেছেন। আবার অনেকে শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। তাই ইংরেজি, গণিত এবং আইসিটি বিষয়ে ডিগ্রি না থাকা শিক্ষকের হার আরও বেড়ে যেতে পারে।
ওই শিক্ষক আরও বলেন, শহরের ধনী স্কুলগুলোতে স্ববেতনে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়ে থাকে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান এনটিআরসিএ’র দিকে তাকিয়ে থাকে না। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের ঘাটতি না থাকলেও অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা গণিত-ইংরেজি পড়ান। এর কারণ হচ্ছে, কোচিং-প্রাইভেট ব্যবসা। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, পরিচালনা কমিটি কিংবা প্রভাবশালী শিক্ষকদের উৎকোচ দিয়ে অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা ইংরেজি-গণিতের ক্লাস নেন শুধু কোচিং বাণিজ্য করতে। সুতরাং, শহরের বড় বড় স্কুলেও অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের গণিত-ইংরেজির পাঠদানের অভিযোগ আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ড. এম তারিক আহসান বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে মাধ্যমিকে শিক্ষকদের বড় একটি অংশ অন্য কোনো চাকরি না পেয়ে এ পেশায় এসেছেন। তাই শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের পদক্ষেপে শিক্ষার্থীর মানের উন্নতি হবে না। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসাবে পাঠদানের মান উন্নয়নে জন্য প্রশিক্ষণ বা পেশাগত ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে তাদের মান উন্নত করতে হবে। মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ হিসাবে অবসরে যাওয়া শিক্ষকের জায়গায় দক্ষদের নিয়োগ করতে হবে। তাদের আকর্ষণীয় করতে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। সেটা হতে পারে ফ্রি স্বাস্থ্য সেবার মতো সুবিধা। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসাবে নিয়োগের শর্ত পাকাপোক্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ করতে হবে। এজন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করতে হবে। উন্নত দেশে রূপান্তর আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এর বিকল্প নেই।
দক্ষতা অর্জনের ওপর প্রভাব : এদিকে গণিত-ইংরেজির শিক্ষক সংকটের প্রভাব শুধু পরীক্ষার ফল নয় দক্ষতা অর্জনের ওপরও পড়ছে। বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা সবচেয়ে বড় এনজিও মোর্চা ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’ সম্প্রতি ‘সেকেন্ডারি স্কুল টিচারস ইন বাংলাদেশ : ইন দ্য লাইট অব এসডিজি ফোর’ শীর্ষক সমীক্ষা চালায়। এর প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত ৫৫ শতাংশ শিক্ষকেরই বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। আর ব্যানবেইসের উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষকের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই।
এ অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের শিখন ফলে। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) দেশব্যাপী এক সমীক্ষায় শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের অর্জিত দক্ষতার চিত্র প্রকাশ করা হয়। এতে ষষ্ঠ, অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চিত্র তুলে আনা হয়। পাঁচটি ব্যান্ডে তুলে ধরা ওই দক্ষতা মানগুলো হচ্ছে-খুব খারাপ, গড়পড়তা, মোটামুটি, ভালো এবং খুব ভালো (ব্যান্ড ২ থেকে ৬)।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাতৃভাষা বাংলায় মাত্র ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভালো বা খুব ভালো পর্যায়ের দক্ষতা অর্জন করেছে। বাকি ৩০ শতাংশের অবস্থা খুব খারাপ থেকে মধ্যম পর্যায়ের। এরমধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ষষ্ঠ শ্রেণির। অবস্থা বেশি হতাশাজনক ইংরেজির ক্ষেত্রে। ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা খারাপ। সাড়ে ২৩ শতাংশের মান মোটামুটি আর বাকিদের মান ভালো। গণিতে প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ। ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর মান ভালো। বাকি ৩২ শতাংশের মান মোটামুটি। এই স্তরেও ষষ্ঠ শ্রেণির প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী খুব খারাপ ও খারাপ মানের (ব্যান্ড ২ ও ৩)।
সোর্স : যুগান্তর