উন্নয়নশীল দেশগুলোর জাতীয় নেতৃত্ব যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে গোটা দেশবাসীকে ভাববন্ধনে আবদ্ধকরণে ইনকরপোরেট ধারণা বা প্রেরণাকে ব্যবহার করতে চাইছে; তখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন সম্ভাবনাসমৃদ্ধ সমাজে অনুরূপ চিন্তা-চেতনার বিকাশ ও প্রয়াস-প্রচেষ্টার পরিবেশ আজ কোন পর্যায়ে? শোষণ, বঞ্চনা ও বণ্টন বৈষম্যের ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকল থেকে ‘মুক্তির সংগ্রামে’ বিজয়ী দেশ ও অর্থনীতির এ পর্যায়ে প্রশ্নটি এই বিবেচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রতীয়মান হয়। স্থান-কাল-পাত্রের পর্যায় ও অবস্থান ভেদে উন্নয়ন ও উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করাও সামগ্রিক সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম উপায় ও উপলক্ষ।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নকামী কল্যাণ অর্থনীতিতে সব পক্ষকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন ও সব প্রয়াস-প্রচেষ্টায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়ে অয়োময় প্রত্যয়দীপ্ত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। একজন কর্মচারীর পারিতোষিক তার সম্পাদিত কাজের পরিমাণ বা পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা কাজের সফলতা-ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয়; অর্থাৎ কাজ না করেও সে যদি বেতন পেতে পারে, কিংবা তাকে বেতন দেয়া হয়, তাহলে দক্ষতা অর্জনের প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশভাবনা মাঠে মারা যাবে। এ ধরনের ব্যর্থতার বজরা ভারী হতে থাকলে যেকোনো উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ভর্তুকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্র্যপ্রপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মণ্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণরাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে; তাহলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায়, উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া এবং রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেনদরবার চলাই স্বাভাবিক। দায়-দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকায় নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহতেও অনিহা চলে আসে। মানবসম্পদ অপচয়ের এর চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণী নির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ্রতা সাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক; সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কিভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব সেদিকে ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়।। ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থীর পরিচয়ে যে অঢেল অর্থব্যয় চলে তা যেন এমন এক বিনিয়োগ; যা অবৈধভাবে অধিক উসুলের সুযোগ আছে বলে। শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বঞ্চিত নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ উদ্ধারে নিবেদিত চিত্ত হওয়ার বদলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব নিজেরা যখন উৎপাদনবিমুখ আর শ্রমিক স্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভূ বনে যায়; তখন দেখা যায়- যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে তাদের তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। স্ববিরোধী এ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উৎপাদন, উন্নয়ন তথা শ্রমিক উন্নয়ন সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
মানুষের দায়িত্ব বোধ দিয়ে কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার এ মানুষের দায়িত্বহীনতায় সমাজের সমূহ ক্ষতি হয়। মানবস¤পদ না হয়ে সমস্যায় পরিণত হলে সমাজের অগ্রগতি দূরের কথা, মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি সভ্যতার বিবর্তনে সহায়তা হয়। মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, সহিংস কার্যকলাপ কিংবা যুদ্ধ ও মারণাস্ত্রের ব্যবহারে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। মানবতার জয়গান মানুষ রচনা করে। আবার মানবভাগ্যে যত দুর্গতি তার স্রষ্টাও সে। মানুষের সৃজনশীলতা, তার সৌন্দর্যজ্ঞান, পর¯পরকে সম্মান ও সমীহ করার আদর্শ অবলম্বন করে সমাজ এগিয়ে চলে। পরমতসহিষ্ণুতা আর অন্যের অধিকার ও দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মাধ্যমে সমাজে বসবাস করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অন্যের অন্যায় অনিয়মের নজির টেনে নিজেদের অপকর্মের দৃষ্টান্ত ব্যাখ্যার বাতাবরণে ঢাকার মতো আত্মঘাতী ও প্রবঞ্চনার পথ পরিহার করে বরং সবার সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগের আবহ সৃষ্টি করতে পারলে সমাজ নিরাপদ বসবাসযোগ্য হয়ে উঠে। সমাজবিজ্ঞানীরা তাই মানুষের আর্থসামাজিক সার্বিক উন্নয়নকে দেশ জাতি রাষ্ট্রের সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করে থাকেন। সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণ সৃষ্টিতে মানুষের সার্বিক উন্নতি অপরিহার্য শর্ত। আগে সমাজ না আগে মানুষ- এ বিতর্ক সর্বজনীন। মানুষ ছাড়া মনুষ্য সমাজের প্রত্যাশা বাতুলতামাত্র। সুতরাং একেকটি মানুষের উন্নতি সবার উন্নতি, সমাজের উন্নতি।
অনাবশ্যক ব্যয় পরিহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুঁজি-ভূমি-শ্রমের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে মুনাফা অর্জন কোম্পানি ব্যবস্থাপনার অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপানে শ্রমিক-মালিকের সপর্ক কোম্পানিগত প্রাণ। সেখানে শ্রমিক যাতে সর্বাধিক মনোযোগ কোম্পানির জন্য দিতে পারেন সে জন্য স্ত্রীকে দেয়া হয়েছে সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহনের ভার। কোম্পানির কাজে সার্বক্ষণিক মনোযোগ দেবেন স্বামী। সংসার চালানোর বিষয় নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফোন যাবে না- বাসা থেকে কোনো ফোন আসবে না কোম্পানিতে। জাপানে নারীদের চাকরি, ব্যবসায়, প্রশাসন, রাজনীতিতে বড় একটা দেখা যায় না। তার কারণ সমাজ তাদের সংসার চালানোর দায়িত্ব দিয়ে পুরুষদের উৎপাদনকর্মে পূর্ণ মনোনিবেশে সহায়তা করার দায়িত্ব দিয়েছে। স্বামীর বেতনের টাকা মাস শেষে পারিবারিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। স্ত্রী ওই হিসাব অপারেট করেন। সংসারের যাবতীয় খরচপাতি স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। স্বামী প্রতি সপ্তাহের শুরুর দিনে তার সাপ্তাহিক হাতখরচ বাবদ টাকা পেয়ে থাকেন। সেই টাকা দিয়ে পুরো সপ্তাহ তার চলতে হয়। সুতরাং স্বামীর পক্ষে অপব্যয় কিংবা বাড়তি খরচ করার কোনো সুযোগ সেখানে নেই। পারিবারিক সঞ্চয় এভাবে প্রথাগত ব্যবস্থাদিতে উৎসাহিত হচ্ছে। জাপানের নারীরা বাইরের কাজে তেমন অবদান রাখছেন না ঠিকই কিন্তু গৃহে যে দায়িত্ব তারা পালন করেন; তার আর্থিক মূল্য ও তাৎপর্য অনেক বেশি।
জাপানে কল-কারখানা কিংবা অফিস-আদালতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন হয় না। অর্থবছর শুরুর পরপর একটি নির্দিষ্ট দিনে শ্রমিক-মালিক পক্ষ একত্রে বসে বিগত বছরের আয়-ব্যয়ের স্থিতিপত্র সামনে নিয়ে খোলাখুলি আলোচনায় বসে স্থির করে আগামী বছরে বেতন বেশি হবে না কম হবে। কোম্পানি টিকলে আমি টিকব- এ নীতিতে বিশ্বাসী সবাই যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী কিংবা তার ছেলেকে কোম্পানির কর্মকালীন আলাদা করে শনাক্ত করা চলে না। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সবাই নিজেকে ওই কোম্পানির চাকুরে হিসেবে বিবেচনা করেন। বছর শেষে কোম্পানির নিট লাভ-লোকসান যা হয় তাই-ই তার প্রকৃত পাওনা। কোম্পানিতে বড়-ছোট বলে কোনো প্রভেদ নেই। আছে কর্মক্ষমতা দক্ষতা আর দায়িত্ব অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস। সেখানে একজন সাধারণ কর্মীরও অবদান রাখার সুযোগ আছে। কোম্পানির সার্বিক অগ্রগতির পেছনে পরামর্শ দেয়ার স্বীকৃতি আছে সবার।
সনি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ মরিতা সান- তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে প্রথমে তিনি পরিদর্শনে যান কারখানার টয়লেটগুলোতে। তিনি মনে করতেন, টয়লেট ও অন্যান্য আঙিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বে যে সব শ্রমিক নিয়োজিত তাদেরও যথেষ্ট অবদান রাখার অবকাশ আছে উৎপাদনে। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন, শ্রমিকরা অবসরে যখন টয়লেটে আসেন; তখন তা যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পান তখন তাতে তাদের মন প্রসন্ন হয়। সিটে ফিরে গিয়ে তারা আরো একনিষ্ঠ সহকারে উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে পারেন। এর ফলে উৎপাদনে উৎকর্ষতা বাড়ে। এভাবে দিনে যদি এক হাজার টেলিভিশন উৎপাদিত হয় কোনো কারখানায়, মরিতা সানের মতে- তার মধ্যে ন্যূনতম চারটি টেলিভিশন উৎপাদন বেশি হয় শ্রমিকের প্রসন্ন মন-মানসিকতায়। তিনি সবাইকে উৎপাদনে যোগ্য অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন। ফলে শ্রেণী ও পর্যায় ভেদে সবাই যার যার কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদন করেন। হোন্ডা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা নিজে হোন্ডা মোটরসাইকেলের ডিজাইন করতেন গভীর রাতে। গভীর মনোনিবেশ সহকারে এ কাজ যাতে তিনি করতে পারেন সে জন্য তার স্ত্রী রাত জাগতেন তার সাথে। রাতে ফেরিওয়ালা মিষ্টি আলু বিক্রি করত সুন্দর সুরে গান করে। মিষ্টি আলু ফেরিওয়ালার গানের সুরে হোন্ডা সাহেবের মনোনিবেশে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, সে জন্য তার স্ত্রী ফেরিওয়ালার পুরো আলু কিনে নিয়ে তাকে ঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করতেন। এ হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি বলে বলীয়ান জাপানে পথিকৃতদের প্রতিষ্ঠার কাহিনী।
টয়োটা পরিবারের উত্থান একজন ব্যক্তির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। অনুসন্ধিৎসাও গভীর নিষ্ঠা অধ্যবসায় সামান্য অবস্থা থেকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এক বিশাল শিল্প সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। কোয়ালিটির প্রশ্নে কোনো আপস নেই- পরিবেশনে মুনশিয়ানায় আন্তরিকতায় কমতি নেই। ডিজাইন ও উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় গভীর অভিনিবেশসহকারে এমন সচেতন ও একাগ্রতার সমাহার ঘটানো হয়ে থাকে যে, যাতে উৎপাদনের প্রত্যেক পর্যায়ে অপচয়-বাতিল-পরিত্যক্তের পরিমাণ কমে আসে।
নজর দিতে হবে, সচেতন, সক্রিয় হতে হবে, সমন্বয় হতে হবে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সামষ্টিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে নানান শিল্পোদ্যোগে ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এর অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দেশটি কৃষি ও ট্রেডিংনির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অগ্রসরমান। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ একটি দেশ। সে কারণে স্বাভাবিকভাবে দেশের কর্মক্ষম জনগণকে কর্মকুশল, দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার অনিবার্যতা মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত। কেননা, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সৃজনশীল কর্মক্ষম জনসমষ্টির আওতায় চলে এসেছে, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট নামে পরিচিত। সনাতন শর্তানুযায়ী ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট মূলত তিন দশক পর্যন্ত সৃজনশীল ও উন্নয়ন অভিসারী অভিযাত্রায় থাকে। ইতোমধ্যে তার এক দশকের বেশি সময় চলে গেছে, সামনে আরো দেড়-দুই দশক বাকি। এই সময়ের মধ্যে বিদ্যমান কর্মোপযোগীদের উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করতে না পারলে বা তাদের উপযুক্ত কর্ম সম্পাদনে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে কিংবা তাদের জন্য উপযুক্ত কাজ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে তারা অলসতায় শয়তানের কর্মশালায় যোগ দিতে পারে কিংবা অকর্মণ্যতায় হতাশায় নিমজ্জিত হতে পারে, যে পরিস্থিতিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। কেননা, সমাজে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেলে উৎপাদনশীলতায় বা জিডিপিতে তাদের অবদান বঞ্চিত হয় দেশ এবং তারা নিজেরা নিজেদের, পরিবারের ও দেশের জন্য বোঝা বা বিপদের বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে জাতির জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর সময় এবং এর জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে বিশেষ মাশুল।
বিগত ৫১ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা এ দেশের জনগণকে বিশেষ করে যুবসমাজকে এখনো পর্যাপ্ত যথাযথ দক্ষ জনসম্পদে বা প্রশিক্ষিত লোকবল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। যার জন্য এ দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছেন অদক্ষ শ্রমিক আর বিদেশের দক্ষ জনবল এ দেশের মধ্য ও উচ্চতর পদগুলোতে বেশি বেতনে নিয়োজিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সমাপনকারী ডিগ্রিধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু তাদের দেশের উদীয়মান শিল্পে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ যোগ্য হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে না। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের সেই বিখ্যাত চরণের মতো- Water water everywhere nor any drop to drink. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় ও বাণিজ্য অনুষদের এক গবেষণায় বাংলাদেশী কর্মী ও ব্যবস্থাপক পর্যায়ের জনসম্পদের মধ্যে চিহ্নিত সীমাবদ্ধতাগুলোর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো- উৎপাদন কিংবা সেবা খাতে করিৎকর্মা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করা বা উপস্থাপন বা তুলে ধরার মতো প্রযোজ্য প্রয়োগিক ভাষা ও জ্ঞানের অভাব; সৃজনশীল তথা উদ্ভাবনী শক্তি প্রকাশে, প্রয়োগে সংশয়, সঙ্কোচ তথা অপারগতা; প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কর্ম দক্ষতা বা কার্যকর জ্ঞানের অভাব; উপযুক্ত বাজার সৃষ্টি বা খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ, নিষ্ঠা ও দক্ষতার অভাব; বাজারজাতকরণে নৈপুণ্য প্রদর্শন, দক্ষতা, আগ্রহ ও তৎপরতায় ঘাটতি; বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবস্থাপনায় অপটু; ক্রয়-বিক্রয় পরিচালনায় পরিবেশনে উপস্থাপনে, নেগোসিয়েশনে নিষ্ঠার অভাব; সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয়াদি ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং সেসব মোকাবেলা তথা সমাধানের পথ পরিক্রমায় সাহস ও প্রজ্ঞার অভাব; লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রায়োগিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা; ব্যবসায়-বাণিজ্য বিনিয়োগ উৎপাদন ক্ষেত্রে উদ্যম ও উদ্যোগকে টেকসইকরণে নিষ্ঠার অপ্রতুলতা।
এটি এখন অনস্বীকার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশী তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বলতা, প্রায়োগিক জ্ঞানের নিম্নগামিতা, প্রশিক্ষণ ও অধিক শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহের অভাব, সৃজনশীল পৃষ্ঠপোষকতা দানের ঘাটতি বা কমতি রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য উঠতি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কিংবা অধিকতর যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো উপর্যুক্ত ও দক্ষ জনবলের যেমন প্রয়োজন; তেমনি টেকসই ও লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ ও সমন্বয়ে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সাথে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকুশলতা। এই প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডে নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে, সে সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে তা মোকাবেলা করতে পর্যাপ্ত ও উপর্যুক্ত লোকবলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের যে কর্ম সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেখানে উপযুক্ত দেশীয় লোকবল সংস্থান করা যাচ্ছে না; অথচ সেগুলো বিদেশীদের দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শিল্প একটি অতি সম্ভাবনাময় শ্রমিকনির্ভর। সেখানে মধ্য পর্যায়ের বেশির ভাগ ব্যবস্থাপক, পরিচালক, নকশাকার হিসেবে নিয়োজিতরা বিদেশী। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, গার্মেন্টের বায়াররা প্রতিবেশী দেশে (যারা আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী) বসে সে দেশের লোক নিয়োগ না করলে আমাদের বাজার হারাতে হবে- এ ধরনের একটি অঘোষিত হুমকি রয়েছে। এর ফলে দেশী শিক্ষিত বেকারকে কর্মসংস্থানের চাহিদার কারণে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং চাকরি না পেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণরা হতাশায় নিমজ্জিত। একই সময়ে দেশের টেকনিক্যাল শিক্ষার পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকায় দক্ষ জনবল সরবরাহের পরিস্থিতি এমন একটি নেতিবাচক পর্যায়ে যাচ্ছে যে, দীর্ঘমেয়াদে তাতে এক করুণ ও আত্মঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আশঙ্কা প্রকাশ পাচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ডেমোগ্রাফিক ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। এ সহ¯্রাব্দের শুরু থেকে বলতে গেলে বিশেষ করে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়ন যখন শুরু হয়; তখন থেকে বাংলাদেশে দক্ষ জনবল বা মানবসম্পদ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়ে নানা উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। দাতা সংস্থার পরামর্শ ও অর্থায়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংস্থা, প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গৃহীত হলেও দৃশ্যমান দক্ষ জনবল সেভাবে যে গড়ে উঠেনি তা বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশে কর্মসৃজন, বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানোর এবং এ দেশে বিদেশীদের নিয়োগ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে প্রতিভাত হচ্ছে। বিগত দেড় দশকে বরং দেখা গেছে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ঊর্ধ্ব ও মধ্যমপর্যায় ব্যবস্থাপক, পরামর্শক, সংগঠন ও কর্মী এসে বাংলাদেশে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন আর্থিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হয়েছে, ফলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে হচ্ছে। অপর দিকে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে দক্ষের পরিবর্তে অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর মাত্রা বেড়েছে। যদিও এ দেড় দশকে দেশে পরীক্ষায় পাসনির্ভর অনেক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে বা শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে কিন্তু উঠতি বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো পর্যাপ্ত ও কার্যকর জ্ঞান দিয়ে তাদের নিয়োগ করা যায়নি এই অনুযোগে যে, তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর কর্মীদের তুলনায় চটপটে, পটু, প্রায়োগিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া থেকে পেছনে রয়েছে। এরূপ, অদক্ষ অর্ধ শিক্ষিত জনসম্পদ বছর বছর তাদের চাকরির বয়স খুইয়ে স্থায়ী বেকারে পরিণত হচ্ছে।
লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের
প্রাক্তন চেয়ারম্যান
সোর্স : নয়া দিগন্ত