২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে। ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেড়েছে।
‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস’-এর জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট’-এর আয়োজনে তুলে ধরা প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের জন্য গড়ে মাথাপিছু ব্যয় হয় চার হাজার ৫৭৮ টাকা। মহানগর ও শহরের তুলনায় গ্রামের হতদরিদ্রদের চিকিৎসা খরচ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৮.৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে ব্যক্তির নিজ খরচে। সরকারি ব্যয় হয়েছে ২৩.৮ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে ছিল ২২.৮ শতাংশ। এ খাতে ২০২০ সালে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ব্যয়ের পরিমাণ ৫ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে ছিল ৭ শতাংশের মতো। চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয়ের সবচেয়ে বেশি হয় ওষুধে, যা ৬৪ শতাংশ।
সিটি করপোরেশন এলাকায় স্বাস্থ্য খাতে দরিদ্র মানুষ ব্যয় করে মোট ব্যয়ের ১ শতাংশ, অন্যদিকে ধনীরা করে ৬৭ শতাংশ। শহরে দরিদ্র মানুষ ব্যয় করে ৪ শতাংশ, আর ধনীরা করে ৫৩ শতাংশ। গ্রামে দরিদ্র মানুষের ব্যয় ১১ শতাংশ, আর ধনীদের ব্যয় ৩৪ শতাংশ।
রাজধানীর একটি হোটেলে এই প্রতিবেদনের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এই মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থার প্রতিনিধি, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মায়া ভ্যানডেনেন্ট বলেন, ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অনেকে বিপর্যয়মূলক অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে। অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা বলেন, ‘ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেশি হলে তা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা। শুধু অর্থায়নই সমস্যার সমাধান নয়। অর্থের যথাযথ ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ’
বাংলাদেশে ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস সেলের ফোকাল পারসন ডা. সুব্রত পাল তাঁদের জরিপের ষষ্ঠ রাউন্ডে পাওয়া ফলাফল তুলে ধরে বলেন, একটি দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি গণ্ডির মধ্যে মোট যে স্বাস্থ্য খরচ হয়ে থাকে সেটিকে বলা হয় মোট স্বাস্থ্য ব্যয়। ২০২০ সালে স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয় হয়েছে সাত লাখ ৭৭ হাজার ৩৪৭ মিলিয়ন টাকা। জিডিপির রেশিও অনুসারে এটি ২.৮ শতাংশ। ২০১৫ সালে যেখানে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৩৭ ডলার, সেটি ২০২০ সালে এসে হয়েছে ৫৪ ডলার।
সুব্রত পাল বলেন, চিকিৎসায় মানুষের খরচ করার প্রবণতা ও সক্ষমতা বেড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তি পর্যায়ে মোট খরচের ৫৪ শতাংশ বা এক হাজার ৭১৪ টাকা খরচ করে দেশের শীর্ষ ধনীরা। অন্যদিকে জনসংখ্যার হতদরিদ্ররা মাথাপিছু খরচ করে ২০০ টাকা। অর্থাৎ শীর্ষ ধনীরা গরিবের তুলনায় আট গুণ বেশি ব্যয় করে।
তিনি জানান, গ্রামাঞ্চলে শীর্ষ ধনীরা খরচ করে মোট ব্যক্তি পর্যায়ে খরচের ৫৭ শতাংশ, যেখানে দরিদ্ররা খরচ করে ২৫ শতাংশ। শহরাঞ্চলে এই খরচ যথাক্রমে ৭৬ ও ১২ শতাংশ। সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় এই হার যথাক্রমে ৮৭ ও ৫ শতাংশ। এতে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ব্যয়ের বেশি অংশটি করে ধনীরা।
বিভাগওয়ারি স্বাস্থ্য খাতে খরচের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোট খরচের ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে ঢাকা বিভাগে, যা সর্বোচ্চ এবং ৩ শতাংশ ময়মনসিংহে, যা সর্বনিম্ন। মাথাপিছু হিসাবে স্বাস্থ্য খাতে ঢাকা বিভাগের জনপ্রতি খরচ করা অর্থের পরিমাণ সাত হাজার ৩৯ টাকা এবং ময়মনসিংহে দুই হাজার ৬০ টাকা। চট্টগ্রাম বিভাগে মাথাপিছু ব্যয় পাঁচ হাজার ৩৮ টাকা বা ২৪ শতাংশ। এ ছাড়া রাজশাহীতে ১০ শতাংশ, ৪০৪৩ টাকা। সিলেটে তিন হাজার ৪৮২ টাকা বা ৭ শতাংশ। রংপুরে দুই হাজার ৩৭২ টাকা বা ৫ শতাংশ। বরিশালে তিন হাজার ৪৮৬ টাকা বা ৫ শতাংশ। খুলনায় মাথাপিছু ব্যয় চার হাজার ৬২ টাকা বা ৯ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, রোগীর খরচ কমাতে হলে প্রাইভেট হাসপাতালের খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আবার একটা বড় অংশ বিদেশে গিয়েও চিকিৎসা নেয়, তারও একটা প্রভাব এতে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতালের যন্ত্রপাতিসহ অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে। এতে করে চিকিৎসা ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ জন্য তদারকি ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। তবে আশার কথা হলো, অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে।
জাহিদ মালেক বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় মিলিয়ে যা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে এনজিও সংস্থাগুলোও রয়েছে। চিকিৎসায় আমাদের মাথাপিছু ব্যয় ৫৪ ডলার, যা শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের চেয়ে কম। আমরা হয়তো জিডিপির শেয়ার কম পাচ্ছি, এটা বাড়ানো দরকার। ’
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘ওষুধ কম্পানির মার্কেটিংসংক্রান্ত যে কোড আছে, এ দেশে সেই কোড মানা হয়? ইথিক্যাল মার্কেটিং কোড এ দেশে মানা হয়? চিকিৎসকরা আমার কথায় মন খারাপ করতে পারেন, কিন্তু অনেক চিকিৎসক শুনি ওমরা পালনে যান ওষুধ কম্পানির টাকায়। অনেকে বলেন, ফ্রিজ নেন, টেলিভিশন নেন। কেউ আছে ফ্ল্যাট পর্যন্ত কিনে দেয়। যদি সত্যি এমন হয় তাহলে এগুলো তো কমানো যায়। সেদিন একটা কম্পানির ওষুধ বাজার থেকে কিনতে গিয়ে দেখলাম তিন স্তরে প্যাকেটিং করে আকর্ষণীয় করেছে, এখানে কি খরচ কমানো যায় না? এই ব্যয় কমালে তো ওষুধের দামও কমানো সম্ভব।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে তাতে আমরা চাপে আছি। ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে আমরা অত্যন্ত চাপে আছি। চেষ্টা করছি ওষুধের দাম স্থিতিশীল রাখতে। ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ওষুধের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।’
সোর্স : কালের কন্ঠ