দেশে তীব্র গ্যাস সঙ্কট চলছে। সার্বিক পরিস্থিতি দিনের পর দিন অবনতিই হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। বিপরীতে ২৬৬ কোটি ঘনফুটের কম গ্যাস সরবরাহ করছে পেট্রোবাংলা। ফলে দৈনিক ঘাটতি থাকছে ১১৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই গ্যাসের সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর না দিয়ে সরকারের উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত ছিল ভুল।
জানা গেছে, গত ৫০ বছরে মাত্র ৬৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে পেট্রোবাংলা। এরমধ্যে গত ১২ বছরে ২০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ৪টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মধ্যে শুধু ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মজুত রয়েছে। তবে পেট্রোবাংলা সম্প্রতি কয়েকটি উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ থেকে গ্যাস প্রাপ্তির খবর দিলেও সেগুলো থেকে গ্যাস প্রাপ্তির হার খুবই কম বলে জানা গেছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গ্যাস সঙ্কটের কারণে সরবরাহ কমে গেছে। সঙ্কট মোকাবেলায় বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। দেশীয় উৎপাদন ও আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েও কাজ চলছে। পেট্রোবাংলা নতুন কূপ খনন, নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, পুরনো কূপগুলো খননের কাজ হাতে নিয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসের দিকে গ্যাস সংকট থেকে কিছুটা পরিত্রাণ মিলতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেট্রোবাংলার হিসাবেই দেশে গ্যাসের ঘাটতির কথা উঠে এসেছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংস্থাটি বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গ্যাসক্ষেত্রগুলো ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উদ্যোগ নেই। নেই স্থলভাগে অনুসন্ধানও। ফলে সহসা কাটছে না দেশীয় গ্যাস সঙ্কট। আর এখন উদ্যোগ নিলেও তার সুফল পেতে কয়েক বছর লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে দু’টি বিদেশি ও তিনটি দেশীয় কোম্পানি দেশে গ্যাস উৎপাদন করছে। তার মধ্যে শুধু সিলেট গ্যাস ফিল্ডেই (এসজিএফএল) দৈনিক উৎপাদন ১৫ কোটি ঘনফুট থেকে কমে সাড়ে ৮ কোটি ঘনফুটে নেমেছে। অন্যান্য দেশীয় কোম্পানির অবস্থাও একই রকম। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে যেমন উদ্যোগ নেই, তেমনি কূপ সংস্কার ও ব্যবস্থাপনাতেও রয়েছে অবহেলা।
সূত্র জানায়, বঙ্গোপসাগরে গ্যাসের বিশাল মজুদের সম্ভাবনা কথা ধারণা করা হলেও বিভিন্ন সময় একাধিক বিদেশি কোম্পানি অনুসন্ধানেও তাতে কোনো সফলতা আসেনি। প্রায় এক দশক আগে সমুদ্রের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মাত্র দুটি ব্লকে ভারতীয় দুটি কোম্পানি যৌথভাবে কাজ করছে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সাগর এলাকাকে অগভীর ও গভীর মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। তার মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক ১১টি আর গভীর সমুদ্রে ব্লক ১৫টি। সাগরের ২৪টি ব্লক এখন উন্মুক্ত। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, পেট্রোবাংলা গত সাত বছর ধরেই দেশের সমুদ্রসীমায় একটি পূর্ণাঙ্গ বহুমাত্রিক জরিপ শুরু করতে পারেনি। ওই কাজের জন্য ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। নানা বাধা পেরিয়ে ২০২০ সালের মার্চে পেট্রোবাংলা টিজিএস ও স্কামবার্জার কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি করে। তাছাড়া কেনা হয়নি পৃথক জরিপ জাহাজও। অথচ প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারত বঙ্গোপসাগর থেকে বিপুল পরিমাণে গ্যাস আবিষ্কার করলেও বাংলাদেশ সমুদ্রের তলদেশে কী সম্পদ লুকিয়ে আছে তা এখনো জানতেই পারেনি।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হলো, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে পেট্রোবাংলা মোট ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। স্থল ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রুনাইসহ গ্যাস ও তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি চুক্তির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এসব দাবির সাথে বাস্তবতার মিল যৎসামান্যই দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মূলত, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অভাব, অপর্যাপ্ত অনুসন্ধান ও আমদানি নির্ভরতার কারণে দেশে তীব্র গ্যাস সঙ্কট শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায় উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় নতুন নতুন কূপ খনন, অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর দেয়া দরকার। অন্যথায় আগামী দিনে গ্যাস সঙ্কট আরো তীব্র হতে তীব্রতর হবে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম