বিশ্ব রাজনীতিতে এক সময় পুঁজিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে তীব্র দ্বন্দ¦ প্রত্যক্ষ করা যেতো। এই রাজনৈতিক দ্বন্দ¦ দেশগুলোর অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করেছিল। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারকগণ মনে করতেন, একমাত্র পুঁজিবাদী অর্থনীতির মাধ্যমেই দ্রুত উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। তারা মনে করতেন, ব্যক্তিগত সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে হবে। তাহলেই সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। যারা বিত্তবান তারা যদি তাদের বিত্তের সীমা আরো বাড়াতে পারে তাহলে যে উন্নয়ন সাধিত হবে তার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উপকৃত হতে পারবে। তারা একটি থিউরি উপস্থাপন করেন যাকে বলা হয়, টিকেল ডাউন ইকোনমি বা চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতি। এই থিউরির মূল উপজীব্য হচ্ছে এই রকম- যদি সমাজে বিত্তবান মানুষের সম্পদ-ঐশ্বর্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় তাহলে সেই উন্নয়নের ফাঁক গড়ে কিছু অর্থ বা খাবার সামগ্রি নিচের দিকে চুঁইয়ে পড়বে। সেই চুঁইয়ে পড়া অর্থ বা খাবার সামগ্রী খেয়ে দরিদ্র মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে। পুঁজিবাদি অর্থনীতিতে নৈতিকতা বলে কিছু থাকতে নেই। সেখানে ব্যক্তিগত সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ বিকাশের সুযোগদানের মাধ্যমে বিত্তের একত্রীকরণই মূল লক্ষ্য। আয় বৈষম্য সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি পেলেও সেখানে করার কিছু নেই। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবক্তাগণ মনে করতেন, ব্যক্তির নিজস্বতা বা সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বলে কিছু থাকতে নেই। মনুষ্য সৃষ্ট সমতা বিধানের মতবাদ হচ্ছে সমাজতন্ত্র। তারা একটি অঞ্চলের সকল মানুষের জন্য একই রকম আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। সাধারণভাবে মনে করা হতো, রাষ্ট্রই সকল সম্পদের মালিক। জনগণ রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করে উৎপাদনের সহায়তা করবে। আর রাষ্ট্রের নিকট থেকে তার প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর মতো উপকরণ পাবে। সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পতন শুরু হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় ধস নামে। কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসক জনরোষে রাষ্ট্র ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। সেই সময় তাদের প্রাসাদে গিয়ে জনগণ দেখতে পান যারা তাদেরকে নীতি কথা শুনাতেন তারা কেমন বিত্ত-বৈভবের মাঝে দিনাতিপাত করতেন। বর্তমানে বিশ্বের কোনো দেশের কার্যত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কার্যকর নেই। এক সময় যে সব দেশ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জন্য বিখ্যাত ছিল তারাও এখন কোনো না কোনোভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে।
বিশ্বব্যাপী এখন পুঁজিবাদী অর্থনীতির জয়জয়কার চলছে। এমন কোনো দেশ নেই যেখানে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে পুঁজিবাদ চালু নেই। কিন্তু তারপরও জনগণের প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটছে না। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী বিত্তের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিশ্ব অর্থনীতির আকার এবং পরিধি বেড়েছে। কিন্তু তাই বলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেছে এটা বলা যাবে না। বিশ্বের বেশির ভাগ সম্পদ এবং উৎপাদিত পণ্য সামান্য কিছু মানুষের হাতে আটকে যাচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষ দশ ধনী ব্যক্তি যে সম্পদের মালিক তৃতীয় বিশ্বের ৪৭টি দেশের মোট সম্পদের পরিমাণও তার সমান নয়। বিশ্ব অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। উপার্জিত বা উৎপাদিত হচ্ছে প্রচুর সম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদ ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত হচ্ছে না। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এখন পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুসরণ করছে। কিন্তু তারা এই ঘরানার অর্থনীতি অনুসরণের মাধ্যমে জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে পারছে না। একমাত্র ইসলামী অর্থনীতিই পারে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করে সর্বাধিক জনকল্যাণ সাধন করতে। ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে যে গর্হিত কোনো পন্থা অবলম্বনের সুযোগ নেই। তেমনি সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সুযোগ নেই। পুঁজিবাদী অর্থনীতি আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাঝামাঝি হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতি। ইসলাম কখনোই চরমপন্থা সমর্থন করে না এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কিছু ইসলাম করতে দেয় না। যেমন কোনো একটি স্থানে ফল প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপিত হতে পারে। আবার মদের কারখানাও স্থাপিত হতে পারে। কিন্তু মদের কারখানা বেশি লাভজনক হলে পুঁজিবাদী অর্থনীতি মদের কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেবে। কিন্তু ইসলাম কখনোই মদের কারখানা স্থাপনকে অনুমোদন দেবে না। কারণ এটা সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যদিও এতে মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। ইসলামী অর্থনীতি আদর্শিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির কোনো আদর্শিক ভিত্তি নেই। তারা শুধু মুনাফা খোঁজে। একটি দেশের শাসক যদি আদর্শিক চরিত্রের অধিকারী হন তাহলে সেই দেশে আদর্শবাদ চর্চা বেশি হবে। একজন আদর্শবাদী শাসক কখনোই কোনো প্রকার দুর্নীতি এবং অনিয়মকে প্রশ্রয় দিতে পারেন না। নীতি ও আদর্শিক চরিত্রের অভাবের কারণেই একটি দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটে থাকে। একজন আদর্শবান শাসক সবার প্রতি সমআচরণ করে থাকেন। আদর্শবাদী শাসকের নিকট থেকে কখনোই দলীয়করণ বা আত্মীয়করণ প্রত্যাশা করা যায় না। তারা উপযুক্ততার ভিত্তিতে সবার প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করে থাকেন।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। এদেশের মানুষ উচ্চ সৃজনশীলতার মালিক। তারা যেকোনো কাজ একবার দেখলেই শিখে নিতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের সেই সৃজনশীলতাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। দলীয়করণ-আত্মীয়করণের মাধ্যমে আমরা প্রশাসনে দুর্বলতা সৃষ্টি করে চলেছি। ফলে যেভাবে দেশের টেকসই উন্নয়ন হবার কথা ছিল তা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক লীড ইকোনমিস্ট একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে লেখা এক নিবন্ধে বলেছেন, বাংলাদেশ মিডল ইনকাম ট্র্যাপে আটকে পড়েছে। মিডল ইনকাম ট্র্যাপ হচ্ছে উন্নয়নের এমন একটি অবস্থা যেখান থেকে সংশ্লিষ্ট দেশটি চাইলেও বেড়িয়ে আসতে পারে না। কিন্তু আসলে বাংলাদেশ দুর্নীতির ট্র্যাপে জড়িয়ে পড়েছে। বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) উদ্যোগে প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১২ তম। টানা চার বছর ২৬ স্কোর করার পর ২০২২ সালে বাংলাদেশ ২৫ স্কোর করেছে। দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০২২ সালে দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে চতুর্থ সর্বনিম্ন। এটা বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি খবর। এর আগে ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতির ধারণা সূচকে শীর্ষস্থান দখল করে। বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারণা সূচকে প্রথম স্থান থেকে ১২তম স্থানে নেমে এসেছে তার অর্থ এই নয় যে, আমরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছি। বাংলাদেশের তুলনায় অন্য কয়েকটি দেশ দুর্নীতি আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবার কারণেই বাংলাদেশের এই অবনমন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কিন্তু একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্নীতি এবং অনাচার। বাংলাদেশে দুর্নীতি এবং উন্নয়ন পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলছে। ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির কারণে উপার্জিত সম্পদ সামান্য কিছু মানুষের হস্তগত হচ্ছে। ফলে বিত্তবান এবং বিত্তহীনের মাঝে সৃষ্ট ব্যবধান আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল চেতনার পরিপন্থি। কারণ স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল সংখ্যাগড়িষ্ঠ মানুষের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের সমতাভিত্তিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তরে ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি এবং অনাচারের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি।
দুর্নীতির নানা রূপ এবং প্রকরণ রয়েছে। আমরা মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সে’র কথা বললেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান এবং কার্যকর কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতা নিয়েও সংশয় রয়েছে। প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অনাচারের কারণেই দুর্নীতি বেশি সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে বাস্তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এমন কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞতা অথবা ভুলবশত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান’ বলে মনে করে থাকেন। আসলে সরকারের কোনো নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নেই। যাকে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান বলি তা আসলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। সরকার দেশের জনগণের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার আমানতদারি লাভ করেন মাত্র। চারটি মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং একমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণ হচ্ছে সরকার। বাংলাদেশে দু’ধরনের প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এক শ্রেণির প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং অন্যটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় সরাসরি মালিকের নিয়ন্ত্রণে। মালিক সেখানে স্বয়ং উপস্থিত থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। সেখানে মালিক অনুপস্থিত থাকেন। ফলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও জবাবদিহিতা থাকে ন্যূনতম পর্যায়ে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ‘দুর্নীতির সঙ্গে দুর্ভাগ্য’ যুক্ত না হলে কারো চাকরিচ্যুৎ হবার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সামান্যতম দুর্নীতির জন্যও একজন কর্মীর চাকরি চলে যেতে পারে। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত কারো পক্ষে সামান্যতম অনিয়ম-দুর্নীতিতে যুক্ত হবার সুযোগ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে মহল বিশেষকে ‘ম্যানেজ’ করতে পারলেই প্রকাশ্যে দুর্নীতি করেও পার পাওয়া যায়। ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে অথবা কাক্সিক্ষত মাত্রায় মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। এর বিপরীতে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর মুনাফা অর্জন করে চলেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য যে সব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে তাতে তাদের কোনোভাবেই লোকসান দেবার কথা নয়।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে নতুন আপদ সৃষ্টি করেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের দলীয় রাজনীতি চর্চায় লিপ্ত হওয়া। জিয়া পরিষদ অথবা বঙ্গবন্ধু পরিষদের ব্যানারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশকে সরকারদলীয় রাজনীতি চর্চা করার প্রবণতা এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, যারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বসে চাকরিরত অবস্থায় দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন তারা কখনোই বিরোধি দল সমর্থনে রাজনীতি চর্চা করেন না। তারা সব সময়ই সরকারি দল সমর্থনে রাজনীতি করেন । রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে বসে যারা রাজনীতি করেন তারা কোনো দলকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন করার জন্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন না। কারণ তারা বিরোধিদলীয় রাজনীতি করেন না। বরং এদের নানা অপকর্মের কারণে একটি জনপ্রিয় সরকারের দুর্নাম হতে পারে। যারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় দলীয় রাজনীতি করেন তাদের অনেকেই অতীত অপকর্ম থেকে বাঁচার জন্য অথবা নতুন করে অপকর্ম করার জন্য সরকারদলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। যারা সৎ এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তারা এসব সুবিধাবাদি কর্মকর্তাদের দ্বারা নানাভাবে নিগৃহীত হয়ে থাকেন। যারা সৎভাবে দায়িত্ব পালন করেন তাদের সব সময়ই সরকার বিরোধি আখ্যা দিয়ে হেনস্তা করা হয়। আমি যখন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের ঢাকা জোনাল অফিসের দায়িত্বে ছিলাম তখন ব্যাংকের সাটুরিয়া শাখার ম্যানেজারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ব্যাপক দুর্নীতির তদন্তের ভার দেয়া হয় আমার উপর। আমি একাধিকবার সরেজমিনে সাটুরিয়া এলাকা পরিদর্শন করে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত প্রতিটি দুর্নীতির প্রমাণ পাই। তিনি এমন সব উপায়ে দুর্নীতি করেন যা ছিল বিস্ময়কর। আমি যে রিপোর্ট প্রদান করি তাতে ম্যানেজারের চাকরি থাকার কথা নয়। কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারলাম সেই ম্যানেজার হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট থেকে আমার দেয়া তদন্ত প্রতিবেদন গায়েব করে পদোন্নতি লাভ করেছেন। এর পর আমার পদোন্নতির সময় সেই ম্যানেজার তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তা আটকে দেন। নির্ধারিত সময়ের ৮ কর্মদিবস পর আমি পদোন্নতি লাভ করি। সেই ম্যানেজার পরবর্তীতে ব্যাংকের ভবন ভাড়া দেবার সময় ব্যাপক দুর্নীতি করলে এবং তা প্রমাণিত হলে তাকে সাসপেন্ড করা হয়। ম্যানেজার ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের একাংশের নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের মূল অংশের নেতাকে বলেন যদি সাসপেনশন প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের মূল শ্রোতধারায় যুক্ত হবেন। বিস্ময়করভাবে তিনি কিছু দিন পরই সাসপেনশনমুক্ত হন এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের মূল ধারায় যুক্ত হন।
জাতীয়ভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবো নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলবো? আমরা যদি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাই তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। রাজনীতি, ব্যবসায়, চাকরি সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন পেশা। আমাদের কর্মজীবনের শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি রাজনীতি করবো, নাকি ব্যবসায় করবো। নাকি চাকরি করবো। এক পেশায় থেকে অন্য পেশায় যুক্ত হবার সুযোগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এমন কি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের চাকরি থেকে অবসরে যাবার পরও একজন কর্মকর্তার রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের সুযোগ দেয়া উচিত নয়। কারণ তারা প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে গেলেও যথারীতি পেনশন ভোগ করেন।
আমরা যদি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে দলীয় রাজনীতি বিতাড়িত করতে না পারি তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা কোনোভাবেই নিশ্চিত করা যাবে না।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম