ঠিক এক বছর আগে কাজের চাপ সামলাতে না পেরে নতুন একটি কারখানা গড়ার পরিকল্পনা করছিলেন ছবি শিকদার। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্যারটেক এলাকার সেই কারখানায় সাবকন্ট্রাক্টের বদলে সরাসরি বায়ারের সঙ্গে কাজ করার স্বপ্ন দেখছিলেন কারখানার কর্মী থেকে উদ্যোক্তার খাতায় নাম লেখানো স্বশিক্ষিত এই নারী।
তবে এক বছরের ব্যবধানে রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিদেশি অর্ডার হারিয়ে এখন স্থানীয় হকার মার্কেটের ছোট ছোট অর্ডার আনছেন। চট্টগ্রামের চাক্তাইয়ের চালপট্টির সেন্স ফ্যাশন নামের কারখানাটিতে তিনি শ্রমিক কমিয়ে এনে কোনোমতে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের গার্মেন্টশিল্প এখন ছবি শিকদারের মতোই কোনোমতে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক লিয়াকত আলী চৌধুরীর মতো অনেকে এখন গার্মেন্ট ব্যবসায় নেই। ১৯৯৪ সালে জেএম অ্যাপারেলস ও নূর এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি গার্মেন্ট কারখানা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। দুটি কারখানাই বন্ধ হয়ে গেছে। জানতে চাইলে গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘কারখানায় আমার প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল। কিন্তু বন্ধের সময় এক টাকাও নিতে পারিনি। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর কারখানা কমপ্লায়েন্সের (কারখানা চালাতে ক্রেতাদের শর্ত) জন্য আমার ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা দরকার ছিল। কিন্তু ব্যাংক থেকে সেই সহযোগিতা পাইনি।’ তিনি জানান, ওই সময়টাতে তিনি বিখ্যাত আমেরিকান স্টোর কোহলসের অর্ডার নিয়ে কাজ করছিলেন।
কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ১৯৭৯ সালে ‘দেশ গার্মেন্ট’ গড়ে যে শিল্পের যাত্রা শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ নূরুল কাদের, চট্টগ্রামে দেশের প্রধানতম সমুদ্রবন্দর থাকা সত্ত্বেও সেখানে পোশাকশিল্পের এমন পিছিয়ে পড়ায় ভাবিয়ে তুলেছে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। বছর বিশেক আগেও দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৩৩ শতাংশের বেশি অবদান ছিল চট্টগ্রামের। অথচ ২০২২ সালে চট্টগ্রামের অবস্থান নেমেছে ৩.৫ শতাংশে। উদ্যোক্তারা বলছেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি-পরবর্তী কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের জন্য ভাড়া ভবনে থাকা প্রায় দুই শ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শিল্প উপযোগী জমির অভাব, ব্যাংকের ঋণ না পাওয়া, সব সুবিধা ঢাকায় কেন্দ্রীকরণ, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সীমিত কার্যক্রমের কারণে বিদেশি ক্রেতারা চট্টগ্রামমুখী না হওয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে চট্টগ্রামের পোশাকশিল্পকে।
বছর বছর আধিপত্য হারিয়েছে : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে পোশাক খাতে জাতীয় রপ্তানির পরিমাণ ছিল দেড় শ কোটি ডলার। এর মধ্যে চট্টগ্রামের অবদান ৫০ কোটি ডলার, যা ছিল মোট পোশাক রপ্তানির ৩৩ শতাংশ। ২০০৫ সালেও পোশাক খাতে মোট রপ্তানির (৬.৯ বিলিয়ন ডলার) প্রায় ২৭ শতাংশ (১.৮৮ বিলিয়ন ডলার) অবদান ছিল চট্টগ্রামের। সে সময় চট্টগ্রামে সচল ৬১০টি গার্মেন্টের মধ্যে সরাসরি ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) করত ৩৪০টি গার্মেন্ট। কিন্তু এরপর থেকে শুরু ঢাকার এগিয়ে যাওয়া আর চট্টগ্রামের শুধু পিছিয়ে পড়ার পালা।
বিজিএমইএ চট্টগ্রামে আঞ্চলিক অফিসে ২০০৫ সালে ইউডি করেছিল ৩৪০টি কারখানা। সেই একই অফিসে ২০২২ সালে সরাসরি ইউডি করা কারখানার সংখ্যা নেমে এসেছে ১৭০টিতে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের মোট গার্মেন্ট রপ্তানি ৬.৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে চট্টগ্রামের ছিল ১.৮৮ বিলিয়ন ডলার বা ২৬.৭২ শতাংশ। ২০২২ সালে দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৪৫.৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও চট্টগ্রামে রপ্তানির পরিমাণ না বেড়ে উল্টো কমে ১.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আর জাতীয় রপ্তানিতে চট্টগ্রামের ব্যবসা কমে ৩.৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই সময় ঢাকা অঞ্চলে রপ্তানি হয়েছে ২৯.৩৮ বিলিয়ন ডলার। চট্টগ্রামে বিজিএমইএভুক্ত ৪২৬ কারখানা থেকে ২০২২ সালে মোট ১.৫৫ বিলিয়ন ডলার তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। বাকি ৬১ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে চট্টগ্রামে বিকেএমইএ সংশ্লিষ্ট কারখানা থেকে। অথচ চট্টগ্রাম থেকে ২০২১ সালেও ১.৯১ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। গত এক বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও চট্টগ্রামে তা উল্টো ১৬ শতাংশ কমেছে।
কেন এমন হলো : চট্টগ্রামে গার্মেন্টশিল্পে আধিপত্য হারানোর শুরু রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর। এটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক লিয়াকত আলী চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের প্রথম ভুল ছিল শুরুর দিকে এখানকার বেশির ভাগ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী কারখানা স্থাপন করেছিলেন ভাড়া ভবনে। যাঁরা ইপিজেডে কারখানা গড়েছেন তাঁরা টিকে গেছেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর কারখানা চালাতে বৈশ্বিক ক্রেতাদের দেওয়া শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়ে এক ধাক্কাতেই শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। নতুন কারখানা গড়ে ঘুরে দাঁড়াতে এ সময় ব্যাংকের সহযোগিতা খুব জরুরি ছিল। কিন্তু সে সময় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা সেই সাপোর্ট পাননি। ঋণের ফাইল ঢাকার হেড অফিসে গেলেও এখানকার কর্মকর্তারা সেটা পাস করিয়ে আনতে পারেননি। এ কারণে ঋণখেলাপির তালিকায় চট্টগ্রামের নাম বেশি।’
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ও তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডের পর ইউরোপ ও আমেরিকার বায়ার সংগঠন অ্যাকর্ড ও অ্যালাইয়েন্সের চাপে বাংলাদেশের বেশির ভাগ কারখানা সংস্কার করতে বাধ্য হয়। এই সময় বিদেশি ক্রেতারা শর্ত দেন, কোনো কারখানা ভাড়া ও যৌথভাবে এক ভবনে থাকতে পারবে না। অথচ চট্টগ্রাম শহরে থাকা বেশির ভাগ কারখানা ছিল যৌথ ভবনে।
কারণ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি আবু তৈয়ব বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রামের পার্থক্য হলো—ঢাকার আশপাশে ভালুকা, গাজীপুর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত গার্মেন্ট কারখানা করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের এখানে জায়গার অভাবে ইচ্ছা থাকলেও বড় কারখানা করতে পারছি না। যে জায়গাগুলো শহরের আশপাশে আছে সেগুলোর এত দাম হয়ে গেছে যে জমি কিনে কারখানা করাটা কঠিন। বাধ্য হয়ে আমাদের চট্টগ্রামের অনেক উদ্যোক্তা ঢাকায় গিয়ে কারখানা করেছেন, এমন ঘটনাও আছে। সুতরাং চট্টগ্রামে শিল্প প্লটের যে অভাব সেগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা নতুন কিছু আশা করতে পারি না।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিজিএমইএ ৫০০ একর জায়গা নিয়ে ‘গার্মেন্টপল্লী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও সেটা এখনো বিনিয়োগ উপযোগী হয়নি।
পোশাকশিল্পে চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসানকে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে এখন সহজেই ঢাকা কিংবা গাজীপুর থেকে কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে আনা যায়। এ কারণে পোশাক কারখানা এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে—এখানকার উদ্যোক্তারা হাই ভ্যালুর পণ্য উৎপাদনে কিছুটা পিছিয়ে আছেন।’
জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকার মধ্যে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে ক্রেতারা ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার চেষ্টা করেন। অর্ডার যদি বেশি হয় তখন চট্টগ্রামকে কাজে লাগান। বন্দরের কারণে এখানে কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। তবে দক্ষতা, সক্ষমতা, ক্রেতাদের চলাফেরা, বিনোদন— সব কিছু মিলিয়ে তাঁরা ঢাকাকেই বেছে নেন। অথচ চট্টগ্রাম বিমানবন্দরটির আন্তর্জাতিক কার্যক্রম আরো বাড়ানো গেলে বিদেশি ক্রেতাদের নজর চট্টগ্রামেও থাকত।’
সোর্স : কালের কন্ঠ