মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট। এই ধরনের বাগধারা বা প্রবাদ প্রবচন বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য রয়েছে। তবে যতই দিন যাচ্ছে ততই এসব প্রবাদ প্রবচন ও বাগধারার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। অবশ্য এটি শুধু বাংলা ভাষাতেই নয়, ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষাতেও কমে যাচ্ছে। হতে পারে, প্রযুক্তিগত বিস্ময়কর উন্নতির সাথে সাথে তার ছোঁয়া ভাষাতেও লেগেছে। তবে যখন ছোট ছিলাম তখনকার সময়ের বড় বড় বাংলা কলামিস্টদের লেখায় বাগধারা, প্রবাদ প্রবচন, বৈজ্ঞানিক এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কিত পরিভাষা ইত্যাদি ব্যবহার করার ফলে সেই লেখাগুলোকে আমার কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হতো। মনের ভাবও প্রকাশ করা যেত বেশ সহজে।
এই যে শুরু করলাম মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট, এই বাগধারা দিয়ে, এটি দিয়ে অতি সহজে বোঝানো যায় যে আওয়ামী সরকার কথায় এক আর কাজে অন্যকিছু। বিভিন্ন অপরাধের বিরুদ্ধে নাকি এই সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে থাকে। তাই যদি হবে তাহলে ছাত্রলীগের বেলায় কি হচ্ছে? আমার তো মনে হয়, আজ নয়, মোটামুটি ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই এই সরকার যুবলীগ ও ছাত্রলীগ বিশেষ করে ছাত্রলীগের ব্যাপারে দরাজ দিল। আমার মনে পড়ে সেই আইয়ুবি জামানার কথা। তখন আমি ছাত্র ছিলাম। ছাত্ররা তখন ঠাট্টা করে বলতে, তুমি যত অপরাধ করে আসো না কেন, ‘আইয়ুব খান জিন্দাবাদ’ এই শ্লোগান দিলে তোমার সাত খুন মাফ। এখন মানুষ বলে, ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে অপরাধ করলে সাত খুন মাফ। এগুলো সব রূপক অর্থে ব্যবহার হয়। আপনি পত্র পত্রিকায় দেখবেন, কোথাও কাউকে পেটাতে গেলে, অথবা কোথাও টেন্ডারবাজি করতে গেলে দেখা যায় ঐ জালিমরা ছাত্রলীগের। ক্ষেত্র বিশেষে যুবলীগের। কারণ তারা ঐ অপকর্মটি করতে যাওয়ার আগে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে ছুটে যায়। আবার অপকর্ম সেরে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে ফিরে আসে। পুলিশ স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকে। অথবা অকুস্থলে পুলিশ না থাকলে যদি থানায় ফোন করা হয় তাহলে তারা বলে যে এই ধরনের কোনো ঘটনার কথা তারা জানে না। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে যদি পুলিশ আসে তখন দেখা যায়, ছাত্র লীগের গুন্ডামি পান্ডামি শেষ হলে তারা আসে। পুলিশকে ফোন করলে তারা গড়িমসি করে। কারণ তারা জয় বাংলা শ্লোগান শুনেই বুঝতে পারে যে ঘটনাটি কারা ঘটিয়েছে।
প্রিয় পাঠক, ভূমিকাতে এত কথা এই জন্য বললাম যে সরকার দেশের মানুষকে এবং বিদেশীদেরকে অষ্টপ্রহর বলে যাচ্ছে যে দেশে তারা আইনের শাসন অব্যহত রাখবে এবং রাজনীতি করার ক্ষেত্রে সকলকে সমান অধিকার দেবে। তারা ক্রিমিনাল অফেন্সকে মোটেই বরদাস্ত করবে না। কিন্তু মুখে এসব কথা বললেও গত কয়েক দিনের পত্র পত্রিকা ভরে আছে ছাত্র লীগের ভয়ংকর ও নৃসংশ জুলুম ও অত্যাচারের কাহিনীতে। অথচ এই কলাম লেখার সময় পর্যন্ত অপরাধীদের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। নীচে আমি কয়েকটি ক্রিমিনাল অফেন্সের উদাহরণ দিচ্ছি। এসব খবর বেরিয়েছে ডেইলি স্টার, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল প্রভৃতি পত্র পত্রিকায় যেগুলোকে আর যাই বলা হোক না কেন, বিএনপি জামায়াতপন্থী বলা যাবে না। আসুন তেমনি কয়েকটি সংবাদের ওপর চোখ বুলানো যাক।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম, “চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ/ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার দুই ছাত্র আইসিইউতে”। খবরে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শাখা ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির দুই ছাত্রকে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। দুই ছাত্র হলেন জাহিদ হোসেন ওরফে ওয়াকিল (২২) ও সাকিব হোসেন (২২)। ছাত্র শিবির সন্দেহে গত বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চমেকের প্রধান ছাত্রবাসে তাদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ। তাদের হাত পা ও মুখে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একই সময়ে আবু রাইয়াদ (২১) ও মোবাশি^র হোসেন (২২) নামের অপর দুই ছাত্রকে নির্যাতন করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। প্রথম আলোর প্রতিনিধি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন যে ঐ দুই ছাত্রের মধ্যে রাইয়াদ বৃহস্পতিবার রাতে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মোবাশি^র নারায়নগঞ্জ গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই দুই ছাত্রই এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
॥ দুই ॥
খবরে প্রকাশ, বুধবার রাতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ঐ চার ছাত্রকে তাদের নিজ নিজ কক্ষ থেকে ডেকে নেয়। অতঃপর তারা অপর একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাদেরকে বাড়ি যেতে বলা হয়। অভিযোগের বিষয়ে চমেক ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা অভিজিৎ দাস বলেন, ওরা (ঐ চার জন ছাত্র) শিবির করে। পুলিশকে জানানো হলে তারা বলে যে তারা বিষয়টি তদন্ত করছে। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
দ্বিতীয় খবরটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ১৫ ফেব্রুয়ারি। ডাবল কলাম হেডিং দেওয়া হয়েছে, “ইবির হলে ছাত্রীকে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন/ নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেত্রীরা”। খবরে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কয়েক দিনের মাথায় ছাত্রলীগ নেতৃত্বের নিষ্ঠুরতার শিকার হলেন এক ছাত্রী। নেত্রীদের কথা না শোনার অভিযোগ তুলে ঐ ছাত্রীর ওপর সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালানো হয়। অকথ্য ভাষায় গালাগাল, মারধর এবং বিবস্ত্র করে তার ভিডিও ধারণ করা হয়। এই ঘটনা কাউকে জানালে তাকে অর্থাৎ ঐ ভিকটিমকে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। ভয়ে ঐ ছাত্রী বাড়ি চলে যান।
গত রবিবার রাতে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ছাত্রী হলের গণরুমে এ ঘটনা ঘটে। গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হল প্রভোস্ট ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে ঐ ছাত্রী এমন লিখিত অভিযোগ করেন। লিখিত অভিযোগে ঐ ছাত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি সানজিদা চৌধুরির নেতৃত্বে তার অনুসারীরা তার ওপর সাড়ে চার ধণ্টা ধরে নির্যাতন চালায়।
আলোচ্য পত্রিকাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে এর আগে গত বছরের আগস্ট মাসে ইডেন মহিলা কলেজের এক ছাত্রী নিবাসেও দুই ছাত্রীর ওপর সাড়ে ৬ ঘণ্টা ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে নির্যাতনের এমন ঘটনা এর আগেও অনেক ঘটেছে। অভিযোগে নির্যাতিতা ছাত্রীটি যা বলেছে তার অংশ বিশেষ নিম্নরূপ, “রোববার দিবাগত রাত ১১ টার দিকে সানজিদা চৌধুরি ওরফে অন্তরা ৭/৮ জন সহ আমাকে গণরুমে নিয়ে যায়। সেখানে কথায় কথায় এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। আরেকজন অভিযুক্তের নাম হলো তাবাস্সুম। নির্যাতনের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতারা ভিকটিমকে কাপড় খুলতে বলে। ভিকটিম অস্বীকার করলে ছাত্রলীগের নেতারা নিজেরাই তার কাপড় খুলে ফেলে এবং নগ্ন ভিকটিমের ভিডিও ধারণ করে।” নির্যাতনের আরো বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আমরা সেগুলোতে আর গেলাম না।
॥ তিন ॥
ছাত্রলীগের জুলুম ও নৃসংশতা এমন সীমা ছাড়িয়ে গেছে যে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে প্রচ- মারধর করে তাকে শিবির বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়। যখন তারা জানতে পারে যে নির্যাতিত ছাত্রটির নাম কৃষ্ণ রায়, অর্থাৎ সে একজন হিন্দু, তখন তারা ক্ষান্ত হয়। এসম্পর্কিত রিপোর্টটিও ছাপা হয়েছে দৈনিক প্রথম আলোতে। শিরোনাম, “তোকে মেরে শিবির বলে চালিয়ে দেবো/রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়”। খবরে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ রায় নামক গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীকে বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইম ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সোলায়মান সহ ৭/৮ জন ছাত্রলীগ নেতা কৃষ্ণ রায়ের রুমে এসে তার বিছানা ছুঁড়ে ফেলে এবং তাকে হল থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। কৃষ্ণ রায় রাজি না হলে তারা তাকে বেদম পেটাতে শুরু করে এবং বলে যে তোকে শিবির ট্যাগ দিয়ে মেরে ফেলা হবে। যখন ভিকটিম বলে যে তার নাম কৃষ্ণ রায় তখন তারা বলে যে একথা যেন প্রকাশ না হয়। হলে তোকে মেরে ফেলে দেবো এবং কেউ সেটি জানতে পারবে না।
॥ চার ॥
ছাত্রলীগের এইসব পাশবিক কীর্তিকান্ড নতুন নয়। বিএনপি এবং জামায়াতের উচিৎ, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বিগত ১৪ বছরে ছাত্রলীগ যে শত শত এবং হাজার হাজার কুকীর্তি করেছে তার একটিও বাদ না দিয়ে প্রতিটি কীর্তি কলাপের বিস্তারিত ফিরিস্তি দিয়ে একটি শে^তপত্র প্রকাশ করা। তাহলে দেখা যাবে যে ছাত্রলীগ নেতা- এই নাম দিয়ে তারা যে সমস্ত কেলেঙ্কারি এবং গর্হিত অপরাধ করেছে সেগুলোর নাটের গুরু বা একাধিক গুরুকে কুলাঙ্গার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ডেইলি স্টারের প্রধান সম্পাদকীয়তে শিরোনাম (বাংলা অনুবাদ), “এরা কি ছাত্র, নাকি ক্রিমিনাল/ ক্যাম্পাসে যারা ছিনতাই এবং জনগণকে হেনস্তা করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক”। একই তারিখে ৮ কলামব্যাপী শিরোনামে যে উপসম্পাদকীয় বেরিয়েছে তার শিরোনাম (বাংলা অনুবাদ), “আপনারা কি নাম দেওয়ার কোনো সাহস পান না?” গোলাম মর্তুজা লিখিত এই উপসম্পাদকীয়ের ইনসেটে বলা হয়েছে (বাংলা অনুবাদ), “এই চারজন ছাত্র শিবিরের সাথে যুক্ত থাকলেও তাদের ওপর অমানুষিক জুলুম চালানোর অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? কে তাদেরকে এই অধিকার দিয়েছে? মেডিকেল কলেজ প্রশাসন? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? অথবা সরকার?” ১৬ ফেব্রুয়ারি ডেইলি স্টারের প্রধান সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম (বাংলা অনুবাদ), “ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে / অঙ্গ ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কি কোনো দিনই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না?” ১৭ ফেব্রুয়ারিতে ডেইলি স্টার একটি উপসম্পাদকীয় ছাপিয়েছে। একটিতে টিটকারি মেরে উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। ইংরেজি শিরোনাম, Well done BCL sisters! / they are fast catching up with their male counter parts.বাংলা অনুবাদ, “ছাত্র লীগের বোনেরা, সাবাস! তারা দ্রুত তাদের ভাইদের (?) সমকক্ষ হয়ে উঠছে”।
এই ধরনের মন্তব্য ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আরো পাওয়া যাচ্ছে। দৈনিক সমকাল উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছেন, ছাত্রলীগ রাজনীতি, নৈতিকতা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করছে। এই উপসম্পাদকীয় নিবন্ধটি লিখেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আইন ও শালিশ কেন্দ্র এবং মানবাধিকার সংস্থা ছাত্রলীগের এই বর্বরতার তীব্র নিন্দা করেছে। এমনকি মাননীয় হাইকোর্টও সরকারের ওপর রুল জারি করেছে।
কিন্তু এসব করে কি লাভ? বিগত ১৪ বছর ধরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব মহল থেকে ছাত্রলীগের গুণ্ডামি, বর্বরতা এবং পাশবিকতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সমালোচনা ও ঘৃনা প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? আওয়ামী সরকার ছাত্রলীগের এসব অপকর্ম সম্পর্কে ‘পিঠে বেঁধেছে কুলা আর কানে দিয়েছে তুলা’।
Email: asifarsalan15@gmail.com
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম