পাঠ্যবইয়ে ভুলের মাশুল দিচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। যৌক্তিক সমালোচনা আর তীব্র প্রতিবাদের পর পাঠ্যসূচি থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর দু’টি বই প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও বাকি আরো তিনটি বই নিয়েও রয়েছে কঠোর আপত্তি। ফলে এই বই তিনটিতে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে চলতি শিক্ষাবর্ষে শ্রেণী কার্যক্রমের পাঠদান নিয়েও চরমভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। পাঠ্যবইয়ের ভুলভ্রান্তি আর অসঙ্গতির দায়ভার যে বা যারাই নিক না কেন বড়দের এই ভুলের মাশুল কিন্তু কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাঁধেই পড়েছে। কেননা শিক্ষার্থীরা নতুনভাবে রচিত পাঠ্যবই হাতে না পাওয়া পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষের স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে পারছে না।
যদিও শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকেই যৌক্তিক সমালোচনা ও ভুলভ্রান্তিকে প্রথমে পাত্তা না দিলেও অবশেষে নতি স্বীকার করতে বাধ্যই হয়েছে সরকার। এ বছরে নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবইয়ে নানা ধরনের অসঙ্গতি ও ভুল ধরা পড়লেও শিক্ষান্ত্রী উল্টো এ বিষয়ে তির্যক মন্তব্য করেছেন শুরু থেকে। এমনকি ফটোশপে এডিট করে পাঠ্যবই ও ছবি নিয়ে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগও করেন তিনি। কিন্তু অবশেষে ভুলের দায় নিয়েই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যক্রম থেকে দু’টি বই প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাকি আরো তিনটি বই সংশোধন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ দিকে গত শুক্রবার এনসিটিবি দু’টি বই প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, শিক্ষাবর্ষের এই পর্যায়ে এসে পাঠ্যসূচি নিয়ে বিতর্ক ও পাঠ্যবই প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণায় শ্রেণিকক্ষে স্বাভাবিক পাঠদানে বিঘœ সৃষ্টি হবে। পাঠ্যবইয়ের এই ভুলের বিষয়ে আগে থেকেই বিতর্ক ছিল; কিন্তু সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একগুঁয়েমির কারণে মাঝপথে এসে বই প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। আবার আরো দু’টি বই সংশোধন করা হবে মর্মে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে একধরনের লেজেগোবরে অবস্থা দেখা দিয়েছে।
অভিভাবকদের অনেকেই প্রশ্ন করেছেন- ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে এসে বই বাতিল করা হলো; কিন্তু নতুন বই শিক্ষার্থীরা কবে পাবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। অন্য দিকে আরো তিনটি বই সংশোধন করার কথা বলা হলেও কোন কোন অধ্যায় বা কী কী বিষয়ে সংশোধন করা হবে সেটি বলা হয়নি। এই অবস্থায় শিক্ষার্থী থাকবে দোটানায়। তারা কোন কোন অধ্যায়ের পাঠ নিয়ে অগ্রসর হবে কিংবা পাঠ্যবইয়ের কোন কোন অধ্যায় বাতিল করা হবে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়।
সূত্র মতে, পাঠ্যপুস্তকের নানা ভুল ও অসঙ্গতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যেই গত শুক্রবার সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ের ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণীর দু’টি বই অনেকটা আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্য দিকে শিক্ষাবর্ষ শুরুর এক মাসের বেশি সময় পর এভাবে পাঠ্যবই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে নজিরবিহীন বলছেন শিক্ষাবিদরা। পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা সরকারি সংস্থা এনসিটিবি বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যপুস্তক দু’টি পাঠদান হতে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
এনসিটিবি সূত্র আরো জানায়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে, যা শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেয়া হবে। প্রসঙ্গত, চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ওই দু’টি বইয়ের নাম একই। সূত্র জানায়, পাঠদান প্রত্যাহার করা বই দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নেয়া হবে। আর বাকি তিনটি বই (ষষ্ঠ শ্রেণীর অন্য দু’টি বই এবং সপ্তম শ্রেণীর আরেকটি বই) সংশোধন করা হবে। এখন পর্যন্ত এটুকুই সিদ্ধান্ত।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা গতকাল শনিবার রাতে জানান, দু’টি বইয়ের পাঠদান প্রত্যাহার করা মানে, এই দু’টি বই কার্যত বাতিল করে দেয়া হলো। এখন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বইগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তুলে আনা হবে। পরবর্তী সময়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পাঠ্যবইয়ের ভুল বা অসঙ্গতি নিয়ে একক কোনো দল বা সংগঠন প্রতিবাদ তোলেনি; বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও সংগঠন এই দু’টি বইয়ের বিষয়ে বেশি আপত্তি তোলে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছিল। এমনকি বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও ‘ভুলে ভরা’ এবং অসঙ্গতিপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক বাতিল করার দাবি তোলা হয়।
সব পক্ষের মতামত বা দাবি সরকার প্রথম দিকে কানে না তুললেও মূলত শুরু থেকেই চাপে ছিল সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এবং পাঠ্যবই ও নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে যুক্ত কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদের সাথে অনলাইনে বৈঠক করেন। সেখানে বই নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের বিষয়গুলো যেমন উঠে আসে, তেমনি বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়েও আলোচনা হয়। বইগুলোর প্রাথমিক পর্যালোচনায় শিক্ষা বিভাগ দেখতে পেয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দু’টির অনেক বিষয়বস্তু আছে, যা এই বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী নয়। ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়, বই দু’টি প্রত্যাহারের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে।
সোর্স : নয়া দিগন্ত