তীব্র সমালোচনার মুখে নতুন পাঠ্যবই ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ শীর্ষক পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একই বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ শীর্ষক দুটি বই সংশোধন করা হবে। সংশোধন হবে ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞানের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের বেশকিছু অধ্যয়।
Advertisement
শুক্রবার ছুটির দিন হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, যে তিনটি পাঠ্যবই সংশোধন করা হবে সেগুলোর বাকি পাঠ যথারীতি পড়ানো হবে। আর সংশোধিত অংশ শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উল্লিখিত পাঠ্যবইগুলোতে খণ্ডিত ইতিহাস অন্তর্ভুক্তি, মুসলিম ইতিহাস বাদ দেওয়া, ধর্মবিরোধী, প্রজনন স্বাস্থ্য ও ট্রান্সজেন্ডারের মতো বিষয় সম্পর্কে পাঠ রাখা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি ওঠে। এছাড়া সার্চ ইঞ্জিন গুগল থেকে হুবহু অনুবাদ তুলে দেওয়া এবং অনলাইন থেকে পাঠ নেওয়া হলেও লেখকের কৃতিত্ব না দেওয়ার অভিযোগ আছে। এসব নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আপত্তি ওঠে।
গত ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ নিয়ে বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ সভাপতি মাওলানা হুশামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর নেতৃত্বে একটি দল সাক্ষাৎ করেন। সব মিলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি উল্লিখিত পাঠ্যবইগুলোর ইস্যুতে বেশ চাপে ছিলেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। ৩১ জানুয়ারি ওই কমিটির সদস্যদের নাম প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কমিটি কাজ শুরুর আগেই পাঠ্যবই প্রত্যাহার আর সংশোধনের ঘোষণা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শিশুদের পাঠ্যবইকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা শ্রেয়। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এতে কিছু অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন সেটি যেমন কাম্য নয়। তেমনি রাজনৈতিক চাপের মুখে তা প্রত্যাহার করাও অপ্রত্যাশিত। পাঠ্যবইয়ের পাঠ নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ খুবই জরুরি। কোন বয়সে কোন পাঠ দেওয়া প্রয়োজন সেটি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন ছিল। পাশাপাশি যারা আপত্তি তুলেছেন তাদেরও অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগের বাস্তবতা মাথায় রেখে সমালোচনা করা উচিত।
উল্লিখিত ৫টি বই-ই সংশোধন এবং এতে বিতর্কিত পাঠ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের খুঁজে বের করতে গত ৩১ জানুয়ারি দুটি কমিটি গঠন করা হয়। একটির নাম ছিল বিশেষজ্ঞ কমিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল হালিম এই কমিটির প্রধান ছিলেন। কমিটিতে শিক্ষক, ধর্ম বিশেষজ্ঞসহ ৭ জন সদস্য ছিলেন।
এছাড়া দায়ীদের চিহ্নিত করতে ৭ সদস্যের কমিটির প্রধান ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার। বিশেষজ্ঞ কমিটিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রণীত পাঠ্যপুস্তকের অসংগতি/ভুল/ক্রটি এক মাসের মধ্যে চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে বলা হয়। কিন্তু কমিটি গত ১০ দিনে কাজই শুরু করেনি।
শুক্রবার রাতে কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুল হালিম যুগান্তরকে বলেন, পাঠ্যবই প্রত্যাহার এবং সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা তিনি শুনেছেন। কিন্তু তারা এ নিয়ে কোনো সুপারিশ করেননি। এমনকি তার কমিটি এখন পর্যন্ত ঠিকমতো কাজ শুরু করেনি।
পাঠ্যবই প্রত্যাহার ও সংশোধনের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলামের স্বাক্ষরে। শুক্রবার রাতে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে সাময়িক ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসাবে পাঠ্যবই প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে গঠিত কমিটি তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। তাদের সুপারিশ পাওয়ার পর সময় নিয়ে ভালো করে সম্পাদনা শেষে উল্লিখিত বই প্রবর্তন করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আকস্মিক জুম প্ল্যাটফর্মে অনলাইন বৈঠক ডাকা হয়। ওই বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব এবং এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগ দেন। তবে সেখানে পাঠ্যবই প্রত্যাহারের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু বিকাল সোয়া ৩টার দিকে হঠাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ফোন করে সিদ্ধান্তের কথা এনসিটিবিকে অবহিত করেন। এর এক ঘণ্টা পর এনসিটিবির চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের দুটি অংশ (বই) আছে। একটির নাম ‘অনুসন্ধানী পাঠ’। এটি মূলত পাঠ্যবই। আরেকটি হচ্ছে ‘অনুশীলনী পাঠ’। এটি দেখে শিক্ষার্থীরা মূল পাঠের আলোকে চর্চা করবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির যে দুটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ অংশ (বই)।
সূত্র জানায়, এই বই দুটিতে বেশকিছু অনাকাক্সিক্ষত ছবি ও ড্রইং যুক্ত করা হয়েছিল। প্রাথমিক খসড়া তৈরির পর যখন তা শিক্ষামন্ত্রীকে দেখানো হয়েছিল, তখন বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি ওইসব ছবি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা ‘অনুশীলনী পাঠ’ বই থেকে ছবি বাদ দিলেও ‘অনুসন্ধানী পাঠে’ তা রেখে দেন। ফলে বইটি নিয়ে আপত্তি বেশি উঠেছে।
অবশ্য অনুশীলনী পাঠেও কিছু পড়া (পাঠ) আছে সেগুলো নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। বিশেষ করে ইতিহাস বর্ণনায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি। যে ছন্দপতন করা হয়েছে সেখানে মুসলিম শাসনের ইতিহাস এবং আন্দোলনে মুসলিমদের অবদান বাদ দেওয়া বা বিদ্বেষপূর্ণ আলোচনার অভিযোগ করা হয়েছে। বিবর্তনবাদের মতো উচ্চতর গবেষণা ও দার্শনিক বিতর্কমূলক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিষয়টি মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে কোরআন শরিফের ব্যাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে এ নিয়ে ইসলামপন্থিরা আপত্তি তুলেছেন। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে আলোচনা আছে এসব বইয়ে। কিন্তু এতে এ ধরনের ব্যক্তির বৈবাহিক অবস্থার দৃষ্টান্ত নিয়েও আপত্তি উঠেছে। আবার বিজ্ঞানে মানুষের বয়ঃসন্ধিকাল আলোচনায় ছেলে ও মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের দিক তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো পাঠ উপযোগী নয় বলেও সমালোচনা হচ্ছে। এই আলোচনাটি ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞানের অনুসন্ধানী পাঠবইয়ে ১১তম অধ্যায়ে আছে।
অভিযোগ আছে, বই রচনার প্যানেল তৈরির ক্ষেত্রে অতি বামপন্থিদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্যানেল মন্ত্রণালয় পর্যন্ত অনুমোদিত হওয়ার কথা। এছাড়া পাণ্ডুলিপির খসড়া তৈরির পর জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটিতে (এনসিসিসি) অনুমোদিত হওয়ার কথা। মিটিং করার সময় না থাকলে এনসিটিবির পূর্ণ বোর্ড এবং মন্ত্রণালয় থেকে শেষ পর্যায়ের মতামত নেওয়ার কথা। তা করা হয়নি।
শুধু তাই নয়, যে দুটি বই নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, তার মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান বই সংশ্লিষ্টদের না দেখিয়ে সরাসরি মুদ্রণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে লেখকদের মধ্যে যারা নিজের মতাদর্শ পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছেন তারা সফল হয়েছেন। এছাড়া এই কাজে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এমনকি এনসিটিবিতে সংশ্লিষ্ট সদস্য তার পছন্দের কিছু কর্মকর্তাকে লেখক বানিয়েছেন। অথচ তাদের কাজ ছিল বই লেখা নয়, লেখার কাজ তদারকি করা ও সাচিবিক সহায়তা দেওয়া। মূলত তাদের আর্থিকভাবে লাভবান করতে এমনটি করেছেন।
শিক্ষাক্রম প্রণয়ন সংক্রান্ত কোর কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান যুগান্তরকে বলেন, আসলে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির উল্লিখিত বইয়ে কিছু অপ্রাসঙ্গিক ও কঠিন পাঠ যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া যে বিষয় নিয়ে উন্নত দেশেও বিতর্ক আছে এবং পড়ানো হয় না তাও যুক্ত করা হয়েছে। এসব করার কারণে সৃষ্ট বিতর্ক নতুন শিক্ষাক্রমের ভালো দিকগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শুক্রবার চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ধর্ম একটি পবিত্র জিনিস। এটি নিয়ে কি কোনো মিথ্যা কথা চলে? যারা মিথ্যাচার করে, অপপ্রচার করে, তাদের কথা সঠিক নয়। তিনি আরও বলেন, এসব বইতে ইসলামবিরোধী কিছুই নেই। তারপরও আমরা মানুষের কথা শুনি, যদি কেউ মনে কষ্ট পায় সেটাকেও গুরুত্ব ইি এবং সম্মান করি। শেখ হাসিনার যারা কর্মী তাদের হাতে কোনোদিন ইসলামবিরোধী কাজ হতে পারে না। তিনি আরও বলেন যে, দুই শ্রেণির বই নিয়ে কথা হচ্ছে, সেগুলো পড়া বন্ধ থাকবে। আগামী বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে একটি করে দুটি বই নতুন তৈরি করে দিব।
সোর্স : যুগান্তর