খানিক পর পর সাইরেনের শব্দ। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি হাসপাতালে আসছে এম্বুলেন্স। নার্সরা পরম যত্নে রোগীদের হাসপাতালে নিচ্ছেন। চারদিকে সুনসান নীরবতা। এম্বুলেন্সে রোগী আসলেও সঙ্গে পরিবারের কেউ নেই। কি করে আসবে? কারও কারও পরিবারের একজন সদস্যও বেঁচে নেই। ধসে পড়া ভবনের নিচেই চাপা পড়ে আছে তারা। আবার বেঁচে থাকলেও সুস্থ থাকার সম্ভাবনা নেই। তারাও অন্য কোনো শহরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তুরস্কের ভূমিকম্পে মহা বিপর্যয়ের পর থেকেই যেন অন্যান্য শহরেও মানুষের মাঝে নীরবতা।
বিজ্ঞাপন
সবাই বাকরুদ্ধ। কখনো কখনো কান্নার আওয়াজও শোনা যায় স্বজন হারানো শোকে। ভূমিকম্পে মহা বিপর্যয়ের পর থেকে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকার হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে। অপারেশন থিয়েটারেও রোগীর দীর্ঘ লাইন। তবে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া শহরগুলোর চিত্র ভিন্ন। এসব শহরের বড় বড় হাসপাতালগুলোই হতাহতদের নতুন ঠিকানা। আঙ্কারা, ইস্তাম্বুলের মতো শহরে রয়েছে একাধিক অভিজাত ও বিশ্বের নামকরা হাসপাতাল। রোগীদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাদের এয়ার এম্বুলেন্সে করে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন শহরের বড়বড় হাসপাতালগুলোয়। সব থেকে বেশি আনা হচ্ছে আঙ্কারা, ইস্তাম্বুল ও কায়সেরি শহরে। এসব শহরে ২ থেকে ৩ হাজারের বেশি শয্যার হাসপাতাল রয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিটি হাসপাতালে কয়েকশ’ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বড় হাসপাতাল ‘আঙ্কারা শেহির হাসপাতাল’। ভূমিকম্পের পর থেকেই হস্তান্তর করা হয়েছে অনেক রোগী। সড়ক পথে কোথাও কোথাও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এসব গুরুতর রোগীদের এয়ার এম্বুলেন্সই একমাত্র বাহন। শেহির হাসপাতালের ‘জরুরি এম্বুলেন্স বিভাগটি’ ভূমিকম্পে আহত রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ভূমিকম্পে আহত রোগীদের পরম যত্নে সেখানে প্রবেশ করানো হচ্ছে। দীর্ঘ ৮/৯ ঘণ্টা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও আইসিইউ সরজমিন ঘুরে দেখা গেল, নিয়মিত বিরতিতে গুরুতর রোগীরা এম্বুলেন্সে আসছে একের পর এক। অভিভাবকহীন রোগীর সংখ্যাই বেশি। কোনো পরিচয়পত্র বা রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও ঢুকানো হচ্ছে পূর্বের হাসপাতালের তথ্য নিয়ে। তবে যাদের পরিচয় রয়েছে তাদের সেসব তথ্য নিয়ে নেয়া হচ্ছে। দু’একজনের স্বজনরা আগে থেকেই অপেক্ষমাণ। বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সকল চিকিৎসা খরচ তুরস্কের সরকার বহন করছে। তাদের দেয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের স্বজন ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় সে সময়ের ভয়াল চিত্র। আঙ্কারা শেহির হাসপাতালের জরুরি এম্বুলেন্স বিভাগে নির্বিকার একাকী বসে আছেন সিরিয়ান নাগরিক ও তুরস্কে আশ্রয়প্রাপ্ত আলী হুসেইন। শোকে পাথর হয়ে গেছেন।
একটু পর পর সন্তানদের ও স্ত্রীর ছবি দেখছেন মোবাইল ফোনে। কথা হয় আলীর সঙ্গে। অশ্রুসিক্ত আলী জানান, তার ৫ সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে থাকতেন কাহরামানমারাসে। এরমধ্যে একমাত্র ছোট সন্তানই বেঁচে আছেন। বড় ৪ সন্তান ও স্ত্রী ভবনের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন। তিনি অক্ষত বের হতে সক্ষম হলেও অন্যরা বের হতে পারেননি। তার সব থেকে ছোট সন্তানকে দীর্ঘ ৭৫ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করে জরুরিভিত্তিতে আঙ্কারায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। তার স্ত্রী ও অন্য সন্তানদের লাশ কোথাও আছে কিনা জানেন না। বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তানকে নিয়েই এখন চিন্তা। সুচিকিৎসা নিয়ে ভাবনা। আর একটু পর পর নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। তিনি তার মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিওতে তার ধ্বংসস্তূপ ভবন দেখান এই প্রতিবেদককে। দেখা যায়, তাদের ভবন মাটির সঙ্গে মিশে কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হয়েছে। এই হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা চলছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী গোলাম সাঈদ রিংকুর। রিংকুর শারীরিক অবস্থা একই রকম। দীর্ঘ সময় বাম হাতটি চাপা পড়ে থাকায় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ ছিল। যে কারণে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে একটি অপারেশন হয়েছে। হাতে আরও একাধিক সার্জারির কথা বলেছেন ডাক্তাররা। ডাক্তার জানিয়েছেন, রিংকুর এই মুহূর্তে বড় ধরনের সমস্যা নেই; তবে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলমান থাকবে।
একই কক্ষে কথা হয় ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রোভিন্স কাহরামানমারাসের তুর্কিস নাগরিক মেহমেত মেসুতের সঙ্গে। দীর্ঘ সময় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা থাকায় কিডনিতে ইনফেকশন হয়েছে বলে জানান। মেসুতের সঙ্গে যখন কথা হয় তখন তার ডায়ালাইসিস চলছিল। প্রতিবেদককে দেখে তিনি চিনে ফেলেন। বেডে বসে ভাই বলে ডাক দেন। বলেন, আপনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমি আপনার ছোট ভাইয়ের বন্ধু এবং রিংকুর প্রতিবেশী ছিলাম। আমাদের ভবন পুরোপুরিই শেষ। বিমূর্ত অবস্থায় তিনি বলছিলেন, আমার স্ত্রী এবং ৩ মাস বয়সী ছেলে মারা গেছেন। আমার আর কেউ রইলো না। ভয়াল সে সময়ের কথা বলছিলেন মেসুত। এদিকে ভূমিকম্পে রোগীদের জরুরি বিভাগের সামনে একটু পর পরই কান্নায় মূর্ছা যাচ্ছিলেন এক মা। তুর্কি এ নাগরিক হারিয়েছেন তার ছোট্ট সন্তানকে। পাশেই সন্তানের বাবা তাকে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন। আর তিনি সন্তানের কথা বলে আর্তনাদ করেন। হাসপাতালটিতে ভূমিকম্পে আঘাতগ্রস্ত যেসব রোগী আসছেন তাদেরকে প্রথমে রেজিস্ট্রেশন করে যার যে সমস্যা রয়েছে সেসব বিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এরপর ভূমিকম্পের রোগীদের জন্য নির্ধারিত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নেয়া হয়। এসব রোগীর বেশির ভাগের কোনো না কোনো অপারেশনের প্রয়োজন হচ্ছে। এসব রোগীকে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে আলাদা আলাদা ডেস্ক। সেসব বিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভূমিকম্পের ভয়াল ছাপ দেখা যায়। হাসপাতালে আসা রোগীদের স্বজনদের সব থেকে বড় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে ভূমিকম্পে সব হারিয়ে নাম, আইডি ছাড়া রেজিস্ট্রেশন হওয়ায়। অনেকের ভেতরেই চিকিৎসা চললেও প্রতিবেশী, পরিচিতিজনরা খুঁজে পেতে বিড়ম্বনায় পড়েন। এ ছাড়া হাসপাতাল এত দীর্ঘ যে, একটি বিভাগ থেকে অন্য বিভাগও খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হয়। আঙ্কারা শেহির হাসপাতাল ছাড়াও আরও একাধিক বড় হাসপাতালে অনেককে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে এতলিক শেহির হাসপাতাল। যেখানে কিছু সময় পর পর ভূমিকম্পে আহত রোগী দেখা যায়।
বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুল কনস্যুলেট বাংলাদেশি আহত রোগীদের সুচিকিৎসায় পরিদর্শন করেন। শুক্রবার আঙ্কারা শেহির হাসপাতালে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রিংকুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসময় রিংকুর চিকিৎসায় অ্যাম্বাসি সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন ইস্তাম্বুল কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল নূরে আলম। তিনি বলেন, রিংকুর জন্য আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে। আমরা তার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। এ ছাড়া আঙ্কারার বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স রফিকুল ইসলাম বলেন, রিংকুকে জীবিত পেয়েছি। আমরা রিংকুর উন্নত চিকিৎসার জন্য তুরস্ক সরকারের কাছে ইতিমধ্যে আহ্বান জানিয়েছি। ওর চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি হবে না। রিংকুর জন্য নগদ কিছু আর্থিক সহযোগিতা ও জরুরি জিনিসপত্র দেয়া হয়েছে। রিংকুকে পরিদর্শনের আগে পূর্বে কাহরামানমারাসে ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা নূরে আলম ও কাতাদাহ জাকারিয়াকে দেখতে যান দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা। পরবর্তীতে ভূমিকম্পে আটকে পড়া অন্যান্য শহরের বাংলাদেশিরা আঙ্কারার যেসব বাসায় আছেন তাদেরও দেখতে যান। এ সময় অ্যাম্বাসির পক্ষ থেকে তাদের জরুরি কেনাকাটার জন্য কিছু আর্থিক সহযোগিতা করা হয়। এদিকে এসব আহত ব্যক্তিদের খাওয়া-দাওয়া ও আঙ্কারায় থাকার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ কমিউনিটি পরিচালিত ও তুরস্ক সরকারের রেজিস্ট্রেশনকৃত সংগঠন ‘বাংলাদেশ এডুকেশন অ্যান্ড কালচার এসোসিয়েশনের (বেকদার)’। এ ছাড়া যাতায়াত ভাড়া, আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে বেকদারের স্বেচ্ছাসেবী ও সংগঠকরা। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় সহযোগিতা করতে তারা কয়েকটি টিমও পাঠিয়েছে।
সোর্স : মানবজমিন