চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নতজানু মানসিকতায় বেপরোয়া ছাত্রলীগ। অপকর্মে তারা দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীর শ্নীলতাহানি, ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তার ঘিরে সংঘর্ষে জড়িয়ে বারবার শিরোনাম হচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি। বৃহস্পতিবার নারী সাংবাদিককে হেনস্তা করে আবারও আলোচনায় এসেছে ছাত্রলীগ। ওই দিন প্রকাশ্যে ১৫-২০ জন নারী সাংবাদিকের মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং তাঁর হাতে থাকা ব্যাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, খোদ ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মারুফ ইসলাম এ অপকর্মে নেতৃত্ব দেন। সবার নাম-পরিচয় গণমাধ্যমে এলেও নীরব প্রশাসন। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চবি ছাত্রলীগের মূল কমিটিকেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। কারণ হিসেবে সংগঠনের নেতাকর্মী বলছেন, বগিভিত্তিক গ্রুপের কাছে জিম্মি হয়ে আছে চবি ছাত্রলীগ।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, নারী সাংবাদিককে শ্নীলতাহানির ঘটনায় লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অতীতেও এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ছাড় দেয়নি প্রশাসন। এবারও কেউ পার পাবে না।
চবির ঘটনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের কোনো সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের কেউ এমন কিছু করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাত্রলীগে অপরাধীর কোনো ঠাঁই নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমাম ইমু বলেন, চবি প্রশাসনের নতজানু মানসিকতার কারণে বেপরোয়া ছাত্রলীগ। নারী সাংবাদিককে হেনস্তায় জড়িতদের তালিকা ও ভিডিও ফুটেজ সরবরাহের পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অতীতেও এমন অনেক ঘটনায় প্রশাসন নীরব থেকেছে। এমনকি ছাত্রলীগের মূল কমিটিও দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, চবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারুফ ইসলামের (২০১২-১৩ সেশন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ) নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে নারী সাংবাদিককে হেনস্তা করা হয়। ভিডিও ধারণ করায় সমকালের চবি প্রতিনিধি মারজান আক্তারের মোবাইল ফোন ও ব্যাগ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এক পর্যায়ে তাঁরা মারজানকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতি লিখিত দিয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থা না নিয়ে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
নারী সাংবাদিক হেনস্তায় আরও যাঁদের সম্পৃক্ততা মিলেছে, তাঁরা হলেন, সমাজতত্ত্ব ২০১৫-১৬ সেশনের মারুফ হাসান, বাংলা ২০১৭-১৮ সেশনের তৌহিদুল হক ফাহাদ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ ২০১৭-১৮ সেশনের শহীদুর রহমান স্বপন, ইতিহাস ২০১৭-১৮ সেশনের একরামুল হক রিয়াদ, ফিন্যান্স ১৯-২০ সেশনের রাকিব, ইংরেজি ২০১১-১৩ সেশনের সাইফুল সুমন, ইংরেজি ২০১৪-১৫ সেশনের লাবিব শাহরিয়ার, ইতিহাস ২০১৯-২০ সেশনের মিজানুর রহমান, ১৯-২০ সেশনের নিপুন মজুমদার, ১৪-১৫ সেশনের কামরুল ইসলাম রাব্বি, ১২-১৩ সেশনের সাদেক হোসেন টিপু, ইতিহাস ১৭-১৮ সেশনের ইমরান হোসেন, আইএমএল ১৪-১৫ সেশনের শোয়াইবুল আলম মাসুদ, বাংলা ১৮-১৯ সেশনের তৌহিদুল হক ফাহাদ ও সৈয়দ আমির হোসেন। তাঁদের মধ্যে সাদেক হোসেন টিপু ছাত্রলীগের সহসভাপতি।
শাটল ট্রেনের বগিতে বিলীন ছাত্রলীগ: এক দশক ধরে শাটল ট্রেন ঘিরে চবিতে রমরমা রাজনীতি। বগি দখল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ান নেতারা। পুরো বগি দখলে রাখতে রংও করা হয়। ক্যাম্পাসে চলে বগিভিত্তিক রাজনীতি। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন উপগ্রুপে ভাগ হয়ে দখল করতে থাকে শাটল। অবস্থা বেগতিক দেখে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ২০১৬ সালে বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও উদ্যোগ নেয়। কিন্তু পরিস্থিতির বদল আসেনি। বরং বগিভিত্তিক রাজনীতির কাছে অসহায় মূল ছাত্রলীগ। আধিপত্য ধরে রাখতে ছাত্রলীগের কমিটির পদধারীরাও জড়িয়ে আছেন বগিভিত্তিক সংগঠনে। বলা চলে, বগিভিত্তিক গ্রুপই নিয়ন্ত্রণ করছে মূল সংগঠনকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলগুলোতে নতুন করে আসন বরাদ্দ বন্ধ রাখায় নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতারা। বগিভিত্তিক রাজনীতিতে সক্রিয়রাই এখন দখলে রেখেছেন এসব আবাসিক হল।
চবি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বরাবর সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের, অন্য গ্রুপটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। তাঁরা আবার ৯ উপদলে বিভক্ত। উপদলগুলোর নাম মূলত শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক সংগঠন থেকে এসেছে। এগুলো হলো- সিএফসি, বিজয়, সিক্সটি নাইন, ভিএক্স, বাংলার মুখ, কনকর্ড, একাকার, রেড সিগন্যাল, এপিটাফ ও উল্ক্কা। একেকটি হলের দখল এখন ছাত্রলীগের একেকটি উপদলের নিয়ন্ত্রণে। এগুলোর নেতৃত্বে আছেন চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রাকিবুল হাসান দিনার, সংগঠনের সাবেক সহসভাপতি নাছির উদ্দিন সুমন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াছ, সাবেক সদস্য সাইদুল ইসলাম, ভার্সিটি এক্সপ্রেসের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী, বাংলার মুখের নেতা ও সাবেক পাঠাগার সম্পাদক আবু বকর, সিক্সটি নাইনের নেতা রাজু মুন্সি ও শামসুজ্জামান সম্রাট, একাকার উপদলের নেতা মঈনুল ইসলাম। নেতাদের বেশিরভাগের ছাত্রত্ব নেই অথবা নেতা হওয়ার আশায় বছরের পর বছর ড্রপ দিচ্ছেন। নিজেরা হলে থাকার পাশাপাশি অনুসারীদেরও জায়গা করে দিচ্ছেন।
চবিতে ভাঙচুর, হামলা, টেন্ডারবাজি, যৌন নিপীড়ন, সাংবাদিক হেনস্তার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। গত বছর সাংবাদিক হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে চারবার। এসব ঘটনার একটিরও বিচার হয়নি। ছাত্রলীগ সামনে এলেই অসহায় হয়ে পড়ে প্রশাসন। গত বছর ১৬ জুন রাতে সাংবাদিকদের কক্ষে এসে হেনস্তা করেন আলাওল হলের ৯ ছাত্রলীগ কর্মী। তাঁরা সবাই শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক উপদল বিজয়ের একাংশের নেতা মোহাম্মদ ইলিয়াসের অনুসারী। কিন্তু প্রশাসন শোকজ করেই দায় সেরেছে।
গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগ কর্মীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে না যাওয়ায় এক সাংবাদিককে মারধর করা হয়। অভিযুক্ত লোকপ্রশাসন বিভাগের আরশিল আজিম নিলয় ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শোয়েব আতিক শাখা ছাত্রলীগের উপদল বিজয়ের কর্মী। বহিস্কার করা হলেও তাঁরা এখনও হলে থেকে দাপট অব্যাহত রেখেছেন।
সোর্স : সমকাল