ভূমিকম্পের দুর্যোগ কখন আসবে কাঁপিয়ে তুলবে তার দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে পূর্বাভাস দেয়া যায় না। তবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্তি¡ক বা ভূস্তরের ভেতরের গঠন-বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন ধরনের ভূতাত্তি¡ক পরিবর্তনের আলামত এবং এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের ইতিহাসক্রম থেকে ভূতত্ত¡ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, অদূর ভবিষ্যতে যে কোন সময়েই শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। নীরব হলেও পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প-প্রবণ বলয়ে বাংলাদেশ ও এর আশপাশ অঞ্চলের অবস্থান।
মাঝেমধ্যে ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো বড়সড় বিপদের আগেই সজাগ হওয়ার জন্য ‘ওয়েকআপ কল’ অর্থাৎ ‘ইশারা’। এর ধারাবাহিকতায় প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এ অবস্থায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। তাছাড়া রাজধানী ঢাকা ও এর চারপাশ, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, সিলেট নগরী, কক্সবাজারসহ দেশের শহর-নগর-শিল্পাঞ্চলে যথেচ্ছ অপরিকল্পিত বাড়িঘর ভবন তৈরি হচ্ছে। নদী-খাল-পুকুর-জলাশয় ভরাট, ‘প্রকৃতির পেরেক’ পাহাড় ও টিলা কেটে-খুঁড়ে ধ্বংস, রাস্তাঘাট-সড়ক-গলি, খোলা জায়গা ক্রমাগত বেদখল ও সরু হয়ে যাচ্ছে। পরিণামে বাড়ছে ভ‚মিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা।
যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের গবেষকদলের ‘নেচার জিওসায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, ভূ-গঠন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে তাতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। শক্তিশালী ভূমিকম্প সংঘটিত হলে তা বাংলাদেশ ও এর আশপাশ অঞ্চলের ১৪ কোটি মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। দু’টি গতিশীল ভূ-পাটাতন পরস্পরের উপর চেপে থাকায় প্রবল ভূমিকম্পের উপযোগী শক্তি ক্রমাগত জমা হচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ ও এর কাছাকাছি বাংলাদেশের অঞ্চল সম্ভাব্য শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হতে পারে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ চুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম ইনকিলাবকে বলেন, ভ‚তাত্তি¡ক গঠন প্রণালী ও পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ও আশপাশের বিশাল অঞ্চল শক্তিশালী ভ‚মিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে অথবা কাছাকাছি বাইরের কোন উৎপত্তিস্থল থেকে প্রবল ভ‚মিকম্পের আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে। অতীতে এ অঞ্চলে শক্তিশালী ভ‚মিকম্পে দুর্যোগের রেকর্ড রয়েছে। সাধারণত ৫০, ১০০, ১৫০ বছর অন্তর শক্তিশালী ভ‚মিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তিনি বলেন, ভয়-আতঙ্ক নয়। সর্বস্তরের জনগণের মাঝে এবং সরকারি উদ্যোগে পূর্ব-প্রস্তুতি ও সতর্কীকরণ প্রয়োজন। সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলায় আমরা যথেষ্ট প্রস্তুত ও সচেতন নই। বরং উদাসীন। অপরিকল্পিত ভবনের কারণে ভ‚মিকম্পে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবনগুলো কারিগরি প্রযুক্তিতে শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ভ‚তত্ত¡ বিজ্ঞানী প্রফেসর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার গবেষণা নিবন্ধে বলেছেন, তিনটি টেকটোনিক প্লেটের (ভ‚-পাটাতন) সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভারত প্লেট, উত্তরে তিব্বত উপপ্লেট এবং পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে বার্মা উপপ্লেট। ভারত ও বার্মা প্লেটের সংযোগ বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত চলে গেছে। পূর্বাংশটি বার্মা প্লেট এবং পশ্চিমাংশ ভারতীয় প্লেটের অন্তর্গত। শিলং মালভ‚মি ভারত প্লেটের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি প্লেট। এটি দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। ভূতাত্তি¡ক গঠন ও টেকটোনিক কাঠামোর কারণেই বাংলাদেশ ভ‚মিকম্প-প্রবণ অঞ্চল।
বিশেষ করে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের ভ‚তাত্তি¡ক ও টেকটোনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায়, সুদূর ও নিকট অতীতে এ অঞ্চলে ভয়াবহ ভ‚মিকম্প হয়েছে। জনবহুল নগর ঢাকার অবস্থান ভ‚মিকম্পের সক্রিয় দু’টি প্রধান উৎস- উত্তরে ডাউকি চ্যুতি (ফল্ট লাইন) ও পূর্বে ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন থেকে মাত্র ৫০ থেকে ২শ’ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই।
আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থ-অবজারভেটরির যৌথ গবেষণায় জানানো হয়, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মাÑ এই তিনটি গতিশীল ভূ-পাটাতনের (টেকটোনিক প্লেট) সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এ অঞ্চলে প্রবল ভ‚মিকম্পের উপযোগী শক্তি ভ‚স্তরে অবিরাম জমা হয়েছে ও হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে ও কিনারে ১৩টি ভ‚-ফাটল (ফল্ট লাইন) রয়েছে। এ কারণে ভ‚মিকম্প বলয়ে ঝুঁঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার, কুমিল্লা, বগুড়া, রংপুরÑ এই বেল্টে ঝুঁকির মাত্রা বেশি। ভ‚-স্তরের একটি ফাটল বা ফল্ট লাইন চট্টগ্রাম শহরের পাশে দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বা হয়ে চট্টগ্রাম উপক‚ল ও সমুদ্র দিয়ে আন্দামান পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য ফল্ট লাইন সিলেট শহরের উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’ ভারতের সীমানায় চলে গেছে। ঢাকার কাছাকাছি সক্রিয় রয়েছে ‘মধুপুর ফল্ট’। রাজধানী ঢাকার বড় ঝুঁঁকি মধুপুর ফল্টের কারণে।
ভ‚মিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. এ এস এম মকসুদ কামালের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) ডিজিটাল জরিপে দেশে সম্ভাব্য ভ‚মিকম্প দুর্যোগের ঝুঁঁকির উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে এসেছে। এতে জানা যায়, বাংলাদেশের ভেতরে বা কাছাকাছি কোন উৎপত্তিস্থল থেকে যদি রিখটার স্কেলে ৭ কিংবা এর ঊর্ধ্ব মাত্রায় ভ‚মিকম্প হয় তাহলে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও সিলেট নগরীর অন্তত ২ লাখ ৫০ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত ও ধসে পড়তে পারে। প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে এক লাখেরও বেশি মানুষের। জরিপে রাজধানী ঢাকায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৭৮ হাজার ভবন অপরিকল্পিত। যেগুলো ভ‚মিকম্প-প্রতিরোধী কারিগরি ব্যবস্থাবিহীন, নির্মাণে গুরুতর ত্রæটিপূর্ণ। চট্টগ্রাম নগরীর ১ লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবনেই বিভিন্ন ত্রæটি-বিচ্যুতি রয়েছে। সিলেট নগরীর ৫২ হাজার ভবনের মধ্যে ২৪ হাজার ভবন ঝুঁঁকিপূর্ণ।
ভ‚মিকম্প নিয়ে যতটা ভয়-আতঙ্ক সেই তুলনায় সব পর্যায়ে এই দুর্যোগের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতিতে পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিকল্পিত নগরায়ন, পাহাড়-টিলা, জলাশয়, নদী-নালা-খাল, ভ‚মিরূপ, পরিবেশ-প্রকৃতিকে সুরক্ষা, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ কঠোরভাবে অনুসরণ, প্রাক-প্রস্তুতি ও গণসচেতনতা প্রয়োজন।
ভ‚-তত্ত¡ বিজ্ঞানী ও ভ‚মিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার গবেষণা নিবন্ধে বলেছেন, ভ‚মিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে এ সম্পর্কে সচেতন হওয়া বেশি জরুরি। ভবন তৈরির সময়ে যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে চলা, সর্বোপরি ভ‚মিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে করণীয় কী সেসব জানা জরুরি। অতীতে সংঘটিত শক্তিশালী মাত্রার ভ‚মিকম্প বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় বা এর আশপাশে হলে কী ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা কল্পনা করলে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না।
কারণ ঢাকা শহরে কেবল পুরোনো নয়, অতি পুরোনো অনেক ভবনও রয়েছে। সেসব ভবনে ঝুঁকি নিয়েই অনেক মানুষ বসবাস করছেন। ভ‚মিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকেই এ বিষয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সোর্স : ইনকিলাব