নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে সীমিত আয়ের মানুষেরা। খরচ বাড়ায় সঞ্চয়ে টান পড়েছে সাধারণ মানুষের। অনেকেই এখন সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ মেটাচ্ছেন। জীবনের বাস্তব অবস্থা বলতে গিয়ে বেসরকারি চাকরিজীবী সাজ্জাদুল ইসলাম জানান, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় একই পরিমাণ পণ্য কিনতে আগের চেয়ে এখন বেশি টাকা প্রয়োজন হচ্ছে। আগে টানাটানি করে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা ব্যাংকে ডিপিএস করতাম। কিন্তু এখন প্রতি মাসেই সংসারের বাজার খরচ বেড়েই চলছে। তার উপর যাতায়াত, বাসা ভাড়া, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খরচ সমানতালে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। কিন্তু আয় সেই আগের জায়গায় স্থির। পরে নিরুপায় হয়ে ডিপিএস বন্ধ করে দিয়েছি।
বিজ্ঞাপন
আর জমানো টাকা থেকেই প্রতি মাসে টাকা তুলে খরচ করতে হচ্ছে। সাজ্জাদ জানান, আর সঞ্চয়ের বিপরীতে যে লাভ পাওয়া যায়, তা দিয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে না। ফলে আমাদের মতো সীমিত আয়ের মানুষ সংসারের খরচ চালাতে সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন।
তার কথার সত্যতা পাওয়া গেছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ প্রতিবেদনে। মূল্যস্ফীতির চাপ, আর্থিক সংকট, ব্যাংকে মুনাফা কম ও বিনিয়োগে নানা শর্তের কারণে কমেছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ফলে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পর যে হারে ভাঙানো হচ্ছে, সে হারে নতুন ক্রয় বা বিনিয়োগ বাড়ছে না। এ কারণে ৬ মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না বেড়ে কমেছে অর্থাৎ ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময় এই খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার, উল্টো ৩ হাজার ১০৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কোষাগার ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) কর্তৃক ২০২২ সালের আগস্টের বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও ঝুঁকি তদারকি বিষয়ে জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নিত্যপণ্য কেনার জন্য ২৯ শতাংশ পরিবারকে সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে। সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে ১০ শতাংশ পরিবার। ৬৪ শতাংশ পরিবার কোনো না কোনোভাবে ঋণ নিচ্ছে। ৪৪ শতাংশ পরিবার বাকিতে পণ্য কিনছে। সংস্থাটি দেশের আট বিভাগের ১২০০ পরিবারের উপর জরিপ পরিচালনা করে এমন তথ্য পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমিত আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ মূলত সঞ্চয় করেন। সংকটকালীন সময়ে নিরাপত্তার কথা ভেবেই নিম্ন্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ সঞ্চয় করেন। কিন্তু এখন যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা আর নতুন করে বিনিয়োগ বা ক্রয় করছেন না। এর কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য জনগণের ব্যয় বেড়েছে। এর বিপরীতে আয় বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির কারণে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে এই কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ তাদের জমানো অর্থ ব্যয় করছে। এগুলো সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার বড় কারণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৫৭ শতাংশে, যা ডিসেম্বর মাসে ছিল ৮.৭১ শতাংশ।
পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাতে বাধ্য হওয়া শ্রেণির মধ্যে মধ্যবিত্তরাই একটি বৃহৎ অংশ। মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মানুষের হাতে টাকা কম। তাই তারা আর আগের মতো সংরক্ষণ করতে পারছে না। সঞ্চয় ভাঙার অর্থ হলো মানুষ সমস্যার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সরকার তার কোষাগার ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে। তথ্যমতে, আলোচ্য ৬ মাসে ৪০ হাজার ৪৭১ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে ৬ মাসে যা বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। এ ছাড়া ডিসেম্বর মাসে মোট ৫ হাজার ৫৪২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এ সময় আগের বিক্রয়কৃত সঞ্চয়পত্রের মূল বাবদ পরিশোধ করা হয় ৩ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা ও সুদ বাবদ ৩ হাজার ৭৯৯ কোটি। অর্থাৎ ডিসেম্বরে মুনাফা ও আসল পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ৩৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এতে শুধু ডিসেম্বরেই সঞ্চয়পত্র থেকে টাকা সংগ্রহের পরিবর্তে উল্টো ১ হাজার ৪৯০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা কোষাগার কিংবা ধার করে পরিশোধ করেছে সরকার। এর আগের মাস নভেম্বরেও সরকার বিক্রীত সঞ্চয়পত্রের চেয়ে ৯৭৮ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছিল।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ২১শে সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১লা জুলাই থেকে মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। এসব কড়াকড়ির প্রভাবে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে। কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনো তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর বিপরীতে প্রথম ৬ মাসে এই খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার, উল্টো ৩ হাজার ১০৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কোষাগার ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
একটি ব্যাংকে ৫ বছর মেয়াদি ডিপিএস (কিস্তিভিত্তিক সঞ্চয়) খুলেছিলেন বেসরকারি চাকুরে খালিদ। প্রতি মাসে জমা রাখছিলেন ২ হাজার টাকা। বাজারে সব জিনিসের দর বাড়ায় সংসার চালাতে গিয়ে দিশাহারা তিনি। খরচ বাড়লেও বাড়েনি তার আয়। নিরুপায় হয়ে ১৮ মাস কিস্তি দেয়ার পর তিনি ডিপিএস বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন জানান, একটা সময় মানুষ ধারদেনা করে সংসার চালিয়েছে। এখন বাধ্য হয়ে সঞ্চয়ের উপর হাত বাড়াচ্ছে।
সোর্স : মানবজমিন