নাছির উদ্দিন শোয়েব : সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ১১ বছর পূর্ণ হলো আজ। দীর্ঘ ১১ বছরেও আলোচিত এ হত্যা মামলার প্রকৃত খুনীদের চিহ্নিত করতে পারেনি র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে’ অপরাধী গ্রেফতারে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই আশ্বাসের পর এখন পর্যন্ত তদন্তের জন্য সময় নেয়া হয়েছে ৯৫ বার। এত বছরেও কেউ জানে না কারা খুন করেছে কিংবা কেন করেছে। তদন্ত থমকে আছে একই বৃত্তে। শুধু প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পরিবর্তন ছাড়া দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
মামলাটি তদন্ত করছে র্যাপিড আ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সম্প্রতি আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় র্যাব। এরপর আর কোনো অগ্রগতির প্রতিবেদনও দেয়া হয়নি। এরআগে গত চার জানুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ৯৫ বারের মতো পিছিয়েছে। এবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৫ মার্চ দিন ঠিক করেছেন আদালত। চার জানুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ছিল। কিন্তু র্যাব প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদুল আলম প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নতুন দিন ঠিক করেন।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যার ঘটনার অনুসন্ধান করা সাংবাদিকদের অনেকে মনে করেন, তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত কয়েক বছর নীরবতা পালন করায় তদন্ত আরো বেশি ব্যাহত হচ্ছে। এই ঘটনা নিয়ে সেসময় সাংবাদিক সংগঠনগুলো ব্যাপক আন্দোলন করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা স্তিমিত হয়ে যায়। এই ইসু নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কার্যকরভাবে চাপ প্রয়োগ করা যায়নি। এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। তবে শিগগিরই তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি: সাগর-রুনি হত্যাকা-ের প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ ৯৫ বার পেছানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন সাংবাদিক নেতারা। এসময় হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচিত না হলে শিগগিরই কঠোর কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। গতকাল শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ সামাবেশ করেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা। বিক্ষোভ সামাবেশ শেষে কর্মসূচি দেয়ার হুঁশিয়ারি দেন সাংবাদিক নেতারা। তারা বলেন, ‘১১ বছরে আমার ভাই সাগর, আমার বোন রুনি হত্যাকা-ের বিচার হয় না। কোথায় যাব আমরা?’ একের পর এক সাংবাদিক হত্যা, হয়রানির শিকার হলেও সরকার বা রাষ্ট্র তা দেখছে না। যাদের এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না বলেও এ সময় মন্তব্য করেন সাংবাদিক নেতারা।
যা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, সাংবাদিক সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকা-ের বিষয়ে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দিতে র্যাবকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমরাও চাই এ হত্যার রহস্য দ্রুত উন্মোচিত হোক। বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রীর কক্ষে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার দ্রুত বিচার দাবিতে ডিআরইউর পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়া হয়। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে ডিআরইউ আমাকে স্মারকলিপি দিয়েছে। বিচার তো আমরা করতে পারব না, আমরা তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারব। আমরা চেষ্টা করছি, অনেক বছর হয়ে গেছে। আমরাও চাই এ রহস্য উন্মোচিত হোক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, উদীয়মান এই দুই সাংবাদিক, যাদের অনেক প্রতিভা ছিল, তারা দেশকে অনেক কিছু দিতে পারত। তারা আমাদের মধ্য থেকে চলে গেছেন। আমরাও চাই কেন এই হত্যকা- হয়েছে, সেটি উদঘাটন করতে। ডিআরইউর স্মারকলিপি আমি র্যাবের ডিজিকে এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। যেন তাড়াতাড়ি একটা কিছু জানায়, সেই নির্দেশনা তাদের দেবো। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি রহস্য উদঘাটনের। সাংবাদিক নেতাদেরও বলেছি, আপনাদের কাছে যদি কোনও তথ্য থাকে সেগুলো আমাদের জানালে, আমরা সেটিও দেখব।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। বেডরুম থেকে ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় বাসায় ছিল তাদের একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ। ঘটনাস্থলে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার’ মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। দুই দিন পর তৎকালীন পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তখন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দুই মাস তদন্তের পর ‘ব্যর্থতা’ জানালে আদালত র্যাবকে তদন্তভার দেন। তারা সাত বছর ১০ মাস ধরে তদন্ত করছে। এই খুনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো ডিএনএ নমুনার পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে মামলার রহস্য উদঘাটন হবে বলে এর আগে র্যাবের কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছিলেন। তবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলেই যে অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব হবে- তেমনটি নাও হতে পারে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, র্যাবের ৬৯টি অগ্রগতি প্রতিবেদনেই ‘গুরুত্বসহকারে তদন্ত চলছে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় ২০০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে। সন্দিগ্ধ আসামীদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের নাম ও ঠিকানা যাচাই এবং পূর্ব ইতিহাস জানার জন্য গতিবিধি, চাল-চলন গভীর ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়। ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বলা হলেও চুরি যাওয়া ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে।
২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দাখিল করা এক প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুজন পুরুষের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রফাইল পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃত আট আসামী, নিহত দুজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত আটজনের মধ্যে পাঁচজন- ফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীরকে। এদের মধ্যে তানভীর, মিন্টু ও পলাশ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছে। বাকিরা এখনো কারাগারে আছে। মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান জানান, এখন কী তদন্ত হচ্ছে তাও আমাদের জানা নেই।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম