রাজনীতি এখন বার্নিং ইস্যু। গত ৮ ফেব্রুয়ারি সকালে দেখি বাসায় সিলিন্ডারের গ্যাস খতম। সিলিন্ডারের গ্যাস বিক্রেতাকে ১২ কেজির একটি দেবার কথা বলতেই জানালো দাম পড়বে ১৮শ টাকা। আজ থেকে ৪-৫ দিন আগে সরকারি তরফে জানানো হয়েছিল ১২ কেজির দাম ১১শ’ প্লাস। কিন্তু দোকানির সাফ জবাব গ্যাস বাজারে তীব্র সঙ্কট। এই সুবাদে উৎপাদক ও খুচরা বিক্রেতা ক্রেতার পকেট কেটে নিচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। কাঁচাবাজার থেকে গ্যাস বাজার পর্যন্ত যত স্তর আছে, সবখানেই লুটেপুটে খাওয়ার অপচেষ্টা চলছে, সেখানে সরকার কাকে বাদ দিয়ে কাকে থামাবে? এখন আমরা কী করব? আমাদের তো সীমিত আয়। আমরা তো চাকরিজীবী বা বেকারজীবী, আমাদের যা কিছু সবই তো নিঃশেষ হতে চলেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তো পকেট ভারী। তাদের তো আর্থিক সঙ্কট নেই। তবে আওয়ামী সমর্থক যারা তাদের পকেট কিন্তু শূন্য। সবার জন্য তো ব্যবস্থা করতে পারে না সরকার। সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে। তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। গতকাল ০৭ ফেব্রুয়ারি টিভির নিউজে শুনলাম সরকার ৯৯ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়েছে। প্রতি বছরই লোন ফেরৎ দেয়। দিয়ে আবারো ঋণ নেয়। কিন্তু এবার আর ফেরৎ দিতে পারেনি বা দেয়নি। কিন্তু এবার আবারো ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। আগের ঋণ পরিশোধ না করেই নতুন করে ঋণ নেবার ফলে সরকার ঋণখেলাপি হয়ে উঠেছে। ঋণখেলাপি শিল্পপতিদের মতোই যদি সরকার খেলাপির জালে বিশাল রুহিতের মতো আটকে যায়, তাহলে দেশের অবস্থা কেমন হবে?
আজ আমাদের বাসায় এবং হতে পারে ঢাকা মহানগরের হাজার হাজার বাসায় তিতাস গ্যাসের সরবরাহের অভাবে এলপিজির সঙ্কটে বা উচ্চমূল্যের ধকলে যারা সিলিন্ডার কিনতে পারবেন না, তাদের কপালে জুটবে হোটেলের খাবার। আর পকেট যদি নিষেধ করে তাহলে? আমরা তো খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার পরও কয়েক কোটি মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে থাকে বা থাকতে হয়। সেটা হয় খাদ্যশস্যের সরবরাহ ত্রুটি ও পুঁজিবাদীদের অসাম্য ধারার রাজনীতির কারণে। আবার এমনটাও হয়, হচ্ছে যে প্রান্তিক মানুষের পকেটে খাবার শস্য কেনার পয়সা থাকে না। তাদের আয় এত সামান্য যে নুন কিনলে, চাল কেনার পয়সা কম পড়ে। এই কনোটেশনটা খুব ভালো- নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তো তাদের জন্য তো আর স্পেশাল কোনো আয়োজন নেই সরকারের। আয়োজনগুলো সবই শহরকেন্দ্রিক। শহরের প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের জন্য ওএমএস চালু করে আমাদের সরকার এবং ধনপতিগণ ভাবেন, আমরা কোটি পরিবারকে খাদ্য দিচ্ছি কম দামে। সত্য এটি। কিন্তু শহরের বাইরেও তো প্রান্তিক মানুষের বাস আছে। গ্রামগুলোতে গরিবের সংখ্যা কেন প্রতিদিনই বাড়ছে? সরকারি পরিসংখ্যান যাই বলুক, দেশে ধনপতিদের সংখ্যা কড়ে আঙুল ছাড়িয়ে মিলিয়ন অঙ্কে গিয়েছে। আবার উল্টো দিকে মিলিয়ন মিলিয়ন প্রান্তিক বা গ্রামের মানুষ গরিব থেকে গরিবতর হচ্ছে এবং তাদের একটি অংশ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আমি বা আমরা যখন মসজিদে যাই নামাজ পড়তে, অনেক হাত পাতা মানুষকে দেখি। আমি যখন মহানগরের পথে হেঁটে যাই তখনো দেখি হাত পাতা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব কি উন্নয়নেরই রাজনৈতিক ও সামাজিক চিহ্ন নয়? আমরা কি এই সব চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি? মুক্তি যুদ্ধের মূলমন্ত্রই তো ছিল গরিবি হটানো, শোষণ হটানো, বঞ্চনাকে নির্বাসনে পাঠানো আর রাজনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা। আহারে, সেই সব স্বপ্ন চিরকালই স্বপ্ন হয়েই রইল।
না, আমরা তো উন্নতি করছি প্রতিনিয়তই। কোথাও না কোথাও আমাদের উন্নয়নের নিশান উড়ছে। আমাদের চোখের সামনে মেট্রোরেল নিঃশব্দে ছুটে চলেছে একশ’ মাইল বেগে। দিয়াবাড়ি টু আগারগাঁও। মাত্র তিনটি স্টেশনে এর যাতায়াত। দেখতে ও শুনতেও ভালো লাগে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে তো দুটি টানেল টিউব উদ্বোধনের অপেক্ষায়, এরকম আরো মেগা পাতাকা উড়ছে, সেখানে কাঁচাবাজারে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এমন কি প্রোবলেম? কুচ পরোয়া নেই! সব ঠিক হয়ে যাবে, সব সয়ে যাবে।
২.
গ্যাস দিয়ে কি আমরা ভাত রাঁধব নাকি রাজনীতি পোড়াব? গ্যাস সঙ্কট, বিদ্যুৎ সঙ্কটসহ শত শত সঙ্কট দিয়ে কি আমরা রাজনীতি পোড়াব, নাকি রাজনীতি দিয়ে ওই সব সঙ্কট পোড়াব? সিদ্ধান্ত আপনাদের, যারা রাজনীতির টুঁটি চেপে আছেন।
দেশব্যাপী দশটি গণসমাবেশ করে এসে বিএনপি এখন পদযাত্রা কর্মসূচি নিয়েছে। সবই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ছিল। কিন্তু সরকারি তরফের অভিযোগ তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। তাদের পাহারা দিয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ, র্যাব। যতটা জানি বা পত্রিকার রিপোর্টে এসেছে বিএনপির ওই সব মিছিল শান্তি-পূর্ণই ছিল। কিন্তু নেকড়ের স্বভাব অনুযায়ী ভাটির পানি যেমন উজানে যেতে পারে, তেমনি সরকারের অভিযোগও। তাই তাদের পুলিশ ৭-৯ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে।
এখন পদযাত্রাকে সরকারি দলের মন্ত্রী-নেতারা বলছেন এটা পদযাত্রা নয় বিএনপির এটা মরণযাত্রা। তাদের চোখে এটা বিএনপির মরণযাত্রা বটে, কিন্তু সেই মরণযাত্রা যদি বুমেরাং হয়ে সরকারি শরীরে এসে লাগে, তখন মরণটা কার হবে?
বিএনপির পদযাত্রার দিন আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছে। এটাকে বলা হচ্ছে পাল্টাপাল্টির রাজনীতি। বিএনপি তো এতবড় দলই না, তাদের শক্তিও নেই, তারা তো রাজপথে শক্তি দেখাতেই পারছে না। কী করে সরকারের পতন ঘটাবে? এরকম একটি দাবি বা কথা বিএনপি তুলেছিল বটে, তবে সেখান থেকে ফিরে এসে দলটি বলছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী লীগকে পদত্যাগ করতে হবে। আর সে জন্যই এই আন্দোলন। আওয়ামী নেতারা উস্কে দিতে চায়- যাতে বিএনপি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে নিজেদের ক্লিন ইমেজে ধ্বংসাত্মক ছাপ লাগায়। কিন্তু এই বিষয়ে অনেক সতর্ক বিএনপি। আওয়ামী নেতারা এটাও বলেছে যে, সরকারের পতন কেমন করে করতে হয় সেটা আওয়ামী লীগ করে দেখিয়েছে। তার একটা হলো লগি-বৈঠার সন্ত্রাস, অন্যটি হলো বিহঙ্গ পরিবহনে গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা। লালবাগের আওয়ামী লীগ নেতা হাজি সেলিমের প্রকাশ্যে একে ৪৭ নিয়ে পল্টনে সন্ত্রাস। এরকম শত শত ঘটনা ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ এখন কতটা না ভদ্র রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ, বিএনপিকে শিক্ষা নিতে হবে আওয়ামী সন্ত্রাস থেকে। আর কখনোই যেন ওই রাজনৈতিক সন্ত্রাসের মধ্যে মাথা না গলায় বিএনপি। গুম খুনের সরকারি ও বেসরকারি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জাতিকে এক অন্ধ আতঙ্কের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। সেই আতঙ্ক আজো তাড়া করছে মানুষকে।
রাজনৈতিক ময়দানে প্রতিপক্ষ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি দল একটি দিনে যে কর্মসূচি দেয়, সেই দিনে, অন্য একটি দল একই দিনে একই সময়ে পাল্টা কর্মসূচি দেয়া কতটা যুক্তিপূর্ণ? কর্মসূচি পালনে কোনো পক্ষেরই কোনো বাধা নেই।
তাহলে কেন দুটি বড় রাজনৈতিক দল, একটি সরকারি ও অন্যটি আন্দোলনরত বিরোধী দল পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেবে? বিএনপি আন্দোলনে আছে। তার কিছু নির্দিষ্ট দাবি আদায়ে। সরকারি দলের কোনো দাবি নেই। তার পরও সে কর্মসূচি দিচ্ছে এই বলে যে, বিএনপি সন্ত্রাস করবে, তাদের ঠেকাতে হবে। তারা যাতে কোনো অপকর্ম করতে না পারে, সেজন্য ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ পাড়ায়-মহল্লায় পাহারা দেবে। তারা বলেছে বিএনপি সন্ত্রাসী দল।
প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে এভাবে দোষারোপ করা ও তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঘের তৈরির পেছনে সরকারি দলের পক্ষে একটাই কারণ থাকতে পারে, তাহলো সরকারি প্রশাসনের সরকারি রাজনীতিকদের দেউলিয়াত্ব। তারা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থামাতে পারছে না। তারা হোলসেলার ও মজুদদারদের ঠেকাতে পারছে না, তারা ওয়াদামাফিক তাদের রাজনৈতিক কাজ করছে না। তারা কেবল রাজনৈতিক শত্রুতাই গড়ছেন, সহকর্মীর হাত তৈরি করছেন না। ফলে গণতান্ত্রিক সমাজের যে স্থিতি ও মানসিকতা গড়ে ওঠা প্রয়োজন, তা তাদের সংস্কৃতিতে নেই।
আমরা একটি সংস্কৃতিহীন রাজনৈতিক পরিবেশের ভেতরে বাস করছি, যা আমাদের পলিটিক্যাল কালচারকে চূড়ান্তে নিয়ে এসেছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।
সোর্স : নয়া দিগন্ত