মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ঋণের টাকা পেতে সরকারকে ২০২৬ সাল শেষে অতিরিক্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে। এর মধ্যে ২০২৪ অর্থবছরে অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে অতিরিক্ত রাজস্ব পেতে মরিয়া সরকার। রাজস্ব বাড়াতে জোর তৎপরতা শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। একইসাথে শুল্ককর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সুবিধা নেওয়া ও হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) বলছে, আইএমএফএয়ের শর্ত মেনে ২০২৪, ২০২৫ এবং ২০২৬ অর্থবছরে বাজেটের মূল রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ২৩৪০ বিলিয়ন টাকা বা ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে। এর মধ্যে ২০২৪ অর্থবছরে অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। শর্ত অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন। তবে অর্জন না করে উপায় নেই। আইএমএফের ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে শর্ত অনুযায়ী জিডিপিতে করের অবদান সাত দশমিক ৮ থেকে ২০২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক তিন শতাংশ, ২০২৫ অর্থবছরে ৮.৮ শতাংশ এবং ২০২৬ অর্থবছরে নয় দশমিক পাঁচ শতাংশে উন্নতি করতে হবে। এদিকে রাজস্ব বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন সরকারের মন্ত্রীরা। সরকারের আয় বাড়াতে এনবিআর নিজেও বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ট্যাক্সের আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে ডেসকোর সহায়তায় বিদ্যুৎ মিটারের মাধ্যমে বাড়ি ও ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিক খুঁজে বের করা হবে। এরপর তাদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করা হবে। বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক ট্যাক্স দেওয়ার যোগ্য। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এ জন্য আমরা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) সঙ্গে কাজ করছি। বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক খুঁজে বের করে ট্যাক্স নিতে গেলে অনেকে বলবেন এ বাড়ি আমার নয়, মালিক এখানে থাকেন না। কিন্তু মিটারের প্রকৃত মালিক খুঁজে পেলে তখন অস্বীকার করতে পারবেন না।
আবু হেনা রহমাতুল মুনিম বলেন, করের আওতা বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। ঠিকাদারদের টিন ও রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। অনেক কোম্পানি টিন সনদ দেখা হয়। এটার কারণে নেট বাড়ছে। অনেক অর্গানাইজেশনের সঙ্গে কাজ করছি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সঙ্গে কাজ করছি। গাড়ির মালিক ট্যাক্স দেন কি না? আমরা ডিপিডিসি ও ডেসকোর সঙ্গে কাজ করছি। বাড়ির মালিক খুঁজে ট্যাক্স নেবো। ঢাকার সব ফ্ল্যাটের মালিকের ট্যাক্স নেওয়া হবে। মিটারের মালিক ধরে বাড়ির মালিক খুঁজে ট্যাক্স নেওয়া হবে। সেই কাজ আমরা করে যাচ্ছি। সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে ইন্ট্রিগেশন করছি। এভাবে কর বাড়ানোর কাজ করছি। তিনি বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ব্যক্তি আয়কর দেওয়া শুরু হয়। ২০০৭ সালের আগে ব্যক্তি করদাতা ছিলেন না। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স দিতে সময় লাগবে। অটোমেশন না হলে হবে না। অনেক টাকার মালিক ধরা যায় না, টাকা কম্বলের ভেতর রাখে।
তিনি বলেন, করজাল বাড়াতে রাজস্ব বোর্ড কাজ করছে। এনবিআর ধাপে ধাপে দক্ষতা, আইটিনির্ভর সক্ষমতা আনছে। দিন দিন এনবি আর অনেক বদলে যাচ্ছে। সামনের দিনে এনবিআর আরও বদলে যাবে, বদলে দেবে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, গ্রামে অনেক উন্নতি হয়েছে। সেখানে সব ফলমূল পাওয়া যায়, অনেক ক্রেতা আছে। আগে দোকানে গরু জবাই করলে পুরো মাংস বিক্রি করতে কষ্ট হতো। এখন দেখা যায়, দিনে ৭ থেকে ১০টা গরু বিক্রি হয়। এখন বিক্রেতা বেড়েছে। করদাতার সংখ্যা শহরে বেশি, কিন্তু গ্রামে নেই এটা আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না।
আমাদের অসমতা অনেক বেশি সহনশীল। সে কারণে আমাদের এখানে বিল গেটসও নেই, জ্যাক মাও নেই। ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকের সংখ্যা কম। গ্রাম থেকে কর আদায় বাড়াতে রাজস্ব বোর্ডের কর্মচারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছানের মতো কর্মকর্তা দরকার। যার আগে টাকা ছিল না, এখন তিনি মিলিয়নিয়ার-বিলিয়নিয়ার হয়ে গেছেন। এখন তাকে ব্যাপক কর দিতে হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ২০২৬ সালে কাস্টমস ডিউটির উপর চাপ পড়বে। সমস্যা আসতে শুরু করবে। তখন টাকাটা তেমন আসবে না। আপনাদের ভ্যাটের পরিধি ও ইনকাম ট্যাক্সে নজর দিতে হবে। এর নেটটা বিস্তৃত করতে হবে। করনেটকে আরও বিস্তৃত করতে ভ্যাটের পরিধি ও ইনকাম ট্যাক্সে নজর দিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কিছু ব্যাপারে আমরা সমন্বয়ের কথা বলি। এটা ভালোর জন্যই। আপনাদের আমাদের মিলিত চেষ্টায় সেটা করতে চাই।
এনবিআর সম্মেলনের এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী শুল্ককর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ কর্তাদের তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি জেলা শহরের এক ব্যবসায়ীর চার কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়লেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। উল্টো পরে কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ‘বিশেষ লেনদেন’ করে পুরো বিষয়টির সুরাহা করা হয়। এতে সরকারের অন্তত চার কোটি টাকার ভ্যাট হাতছাড়া হয়েছে। তিনি বলেন, বেশি রাজস্ব আদায় করলে বা ভ্যাট ফাঁকি বের করলে কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা হয়। এ কাজ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হয়। কিন্তু যারা বেশি রাজস্ব দেবে সে সব ব্যবসায়ীদেরও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, করের হার নয়, করদাতার সংখ্যার মধ্য দিয়ে কর আহরণ বাড়াতে হবে। রাষ্ট্র আমাদের যেসব সেবা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেসব সেবা দিতে হলে বাড়াতে হবে কর আহরণ।
ব্যবসায়ী আকবর আলী রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের অনিয়মের কথা তুলে ধরে বলেন, আমার আয় ফিক্সড। বিভিন্ন কোম্পানি ডিভিড্যান্ড দেয় আর বাড়িভাড়া পাই। তারপরেও ওনারা এগুলো অ্যাকসেপ্ট করেন না। এটা নাই ওটা নাই বলে অ্যাসেসমেন্ট করে। এটা স্বচ্ছ করতে হবে। স্বচ্ছ না হলে যারা ট্যাক্স দেয় তাদের প্রতি জুলুম হচ্ছে। যারা দিচ্ছে না তারা অনেক ভালো আছে। অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে রাজস্ব বোর্ড বড় অংকের কর থেকে বঞ্চিত হয়।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম