সড়ক দুর্ঘটনা থামছেই না। মৃত্যুর মিছিল যেন প্রতিনিয়ত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রায়ই এমন সব মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে যাতে পুরো পরিবার একই সাথে লাশ হয়ে ঘরে ফিরছে। দেখা যাচ্ছে তাদের জন্য আহাজারি করারও আর কেউ জীবিত থাকছে না। অথচ নিরাপদ সড়ক বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রাণের দাবি। সকলেই চায় সড়কে মৃত্যুর থাবা স্তব্ধ হোক। সড়ক নিরাপদ করা রাজা-প্রজা সবারই একান্ত প্রত্যাশা। কারণ, এর সঙ্গে জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক জড়িত। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানেই জীবনহানি, পঙ্গুত্ব, সম্পদের ক্ষয়খতি, আহাজারি; কারো কারো ক্ষেত্রে একটি সড়ক দুর্ঘটনা মানে সারা জীবনের কান্না। বর্তমানে এদেশে নিত্যদিন নিত্য-নতুন আইন হচ্ছে কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। বরং অনেক ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগ হচ্ছে বেশি। সড়কের নিরাপত্তায়ও নতুন করে নতুন আইন হয়েছে। তার কিছু প্রয়োগও শুরু হয়েছে বলে জানতে পেরেছি কিন্তু এত কিছু করেও কি সড়ক দুর্ঘটনা মোটেই কমানো গেছে? না, সড়ক দুর্ঘটনা একটুও কমানো যায়নি। আমরা মনে করি আইন করে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বন্ধ করা যাবে না।
নিরাপদ সড়কের জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, জনসম্পৃক্ততাÑ বিশেষ করে মালিক, চালক ও জনসাধারণের সচেতনতা, নৈতিকতা, মানবিকতা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করা। সবাইকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া। গ্রামগঞ্জ, শহর, বন্দর, অলি-গলি সব স্থানেই রাস্তা পারাপারের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ দিকনির্দেনা তৈরি করা। জেব্রাক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস তৈরি করা। জেব্রাক্রসিং কি জিনিস তা সাধারণ মানুষকে অবহিত করা। এসব বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো। আর এক্ষেত্রে সবার এগিয়ে আসা ছাড়া কোনো পথ নেই। সড়ক নিরাপদ না হলে প্রশাসন, সরকার ও জনগণ সবাইকেই এর মাশুল দিতে হবে। আমাদের একটু উন্নত বিশে^র দিকে তাকাতে হবে। তারা কিভাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে সম্ভব হচ্ছে তা নিয়ে ভাবতে হবে, গবেষণা হতে হবে। বিশেষ করে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৭ মে, ২০২২ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে শুধু এক মাসেই ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এই সমস্ত দুর্ঘটনায় ৫৪৩ জন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ৬১২ জন আহত হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৬৭ জন নারী ও ৮১ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মোট ২০৬ জন মারা গেছে, যা মোট মৃত্যুর ৩৭.৯৩ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে দুর্ঘটনায় প্রায় ১১৬ জন পথচারী এবং ৮৭ জন চালক ও হেলপার নিহত হয়েছে। ছয়টি নৌপথ দুর্ঘটনায় আটজন নিহত এবং ৬জন নিখোঁজ এবং ২১টি ট্রেন দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ৩ মে ঈদের দিন থেকে বৃহস্পতিবার ৫ মে ২০২২ পর্যন্ত তিন দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দুই শতাধিক। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঈদের দিন ১৮ জন, ঈদের দ্বিতীয় দিন ১৫ জন ও তৃতীয় দিন ১২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতদের বেশিরভাগই ঈদে ঘুরতে বের হয়েছিলেন। বাস, পিকআপ, মাইক্রোবাস, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে।
শুধু উৎসব-অনুষ্ঠানে নয়, সড়ক দুর্ঘটনা এখন প্রতি মুহূর্তের ঘটনা। দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানা রকম পরামর্শ এসেছে বিভিন্ন সময়, বিভিন্নভাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এর মধ্যে আমাদের কাছে মনে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধানতম কারণ হচ্ছে জনসচেতনতার অভাব। এখানে আমরা পরামর্শের বিষয়ে লিখবো না। কারণ এই বিষয় নিয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যাহোক, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ফ্রান্স সরকারের একটি উদ্যোগ বিশে^ বেশ আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে। বিষয়টা আমারও দৃষ্টি কেড়েছে।
উল্লেখ্য ফ্রান্সের বিভিন্ন হাইওয়েতে বা ইতিপূর্বে যে সমস্ত স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে হীরক আকৃতির চিহ্ন দেয়া আছে এবং সেখানে একটি করে স্মৃতি ফলক তৈরি করা আছে। হীরার আকৃতির চিহ্নগুলি হলো সাউথ ডাকোটা হাইওয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এগুলো এক একটি স্মারক এবং সতর্কতার প্রতীক। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, রাজ্য তাদের মোটরচালিত যানবাহনের কারণে প্রাণহানির স্থানে এগুলো স্থাপন করেছে, যা তাদেরকে রাস্তার পাশে ওয়াল এরিয়া এবং অন্যান্য পর্যটন ছিটমহলে ভ্রমণকারীদের এই বিলবোর্ডের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। যেহেতু ফ্রান্সে সড়ক দুর্ঘটনা খুবই কম তাই অনেকে বর্তমানে এই বিলবোর্ডগুলো দেখে বিরক্তও হন। কারণ তারা মনে করেন, এখন ফ্রান্সে সড়ক দুর্ঘটনা হয় না বললেই চলে অতএব এখন আর এই বিলবোর্ডের প্রয়োজন নেই, ইত্যাদি।
ফ্রান্সের যে সব দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতে এই স্মৃতিফলক আছে, সেখানে প্রয়োজনীয় স্থানে জেব্রাক্রসিং আছে, স্পিডব্রেকার আছে, আছে ফুট ওভারব্রিজ। প্রত্যেক চালককেই বাধ্যতামূলক এখানে কয়েক সেকেন্ড থামতে হয়, ‘কেন মরবে?’ এই কথাটা চিন্তা করতে হয়। এটা প্রত্যেক পথচারীকে এক মুহূর্ত্যরে জন্য হলেও মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য করে। এটা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষ যখন সামান্য সময়ের জন্য হলেও মৃত্যুর কথা স্মরণ করে তখন তার মধ্যে আত্মসচেনতা বৃদ্ধি পায়। তাকে একদিন মরতে হবে এটা ভাবতে শেখায়। অল্প সময়ের জন্যে হলেও বুঝতে শেখায় ‘জীবন একটা মহামূল্যবান সম্পদ এটা একবার চলে গেলে আর কখনো ফিরে আসে না’। অতএব সড়কে বেপরোয়া হলে চলবে না। আমাদের দেশেও দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোতে এ ধরনের কিছু করা যায় কিনা তা একটু ভাবা যেতে পারে। আমাদের দেশে তো মৃত্যু চাল-পানির মতো নগণ্য হয়ে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু তো আরো নগণ্য মানে ছেলেখেলার মতো। অতএব, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম