মাত্র ১ কোটি ১৯ লাখ টাকার ঋণ ফেরত পেতে ২১২ কোটি টাকা সুদ মাফ করে দেওয়ার মতো আজব কাণ্ড ঘটেছে জনতা ব্যাংক চট্টগ্রামের লালদীঘি শাখায়। একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ৩৩ বছর আগে ওই টাকা ঋণ নিয়ে তা তারা পরিশোধ করেনি। ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার পর এখন সেই ঋণ সুদে-আসলে দাঁড়িয়েছে ২১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকায়। আড়াই যুগের বেশি সময় ধরে খেলাপি হওয়া ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে ঋণ দেওয়া আসল ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা আদায়ে ২১২ কোটি টাকার সুদই মাফ করে দেয় ব্যাংকটি। তবে ২১২ কোটি টাকার সুদ মাফের পর শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি আসল অর্থও পরিশোধ করেনি। মাত্র ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে ফের উধাও ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামের মডার্ন জুট মিলস লিমিটেডের খেলাপি ঋণ নিয়ে এমন অবাক করা ঘটনার জন্ম দিয়েছে জনতা ব্যাংক।
এ ব্যাপারে জনতা ব্যাংকের লালদীঘি শাখার এজিএম নুরুল আলম বলেন, ঋণখেলাপিরা সুদ মওকুফের আবেদন করেছিলেন। তা পরিচালনা পর্ষদে পাঠানো হলে তাঁরা সুদ মাফ করেন। এখানে শাখার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি অসুস্থ। হাসপাতালে থাকায় বেশি কথা বলতে পারছি না।
মডার্ন জুট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম নাজমুল হোসেনকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. রেজাউল করিম বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের ৩৩ বছরের পুরোনো খেলাপি ঋণের মামলায় ২১২ কোটি টাকার সুদ মাফ করে দেওয়ার ঘটনাটি আইন মেনে করা হয়েছে কিনা, তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কোটি টাকা আদায়ের জন্য ২১২ কোটি টাকার সুদ মাফ করলেও আসল টাকাই আদায় করতে পারেনি ব্যাংকটি। ১২ কিস্তিতে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকার আসল অর্থ ফেরত দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল ব্যাংক।
শেষ রক্ষা হয়নি :১ কোটি ১৯ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ নিয়ে বছরের পর বছর টালবাহানা করে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গিয়েছিলেন সাত ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী। কিন্তু এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। ৩৩ বছরে একবার তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও তা ফাইল চাপায় পড়েছিল। কিন্তু এবার সাত ঋণখেলাপির প্রতিষ্ঠানের ঠিকানার পাশাপাশি তাঁদের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানায়ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠাচ্ছেন আদালত। গত ২ ফেব্রুয়ারি সাত ঋণখেলাপির প্রত্যেককে পাঁচ মাস করে দেওয়ানি সাজা দেন আদালত। সাজা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু হওয়া ঋণখেলাপিরা হলেন- মডার্ন জুট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম নাজমুল হোসেন, পরিচালক মাহমুদর রহমান, এ কে এম নুরুল হোসেন, রোকেয়া হোসেন, এম এ সানা, মনোয়ারা হোসেন এবং রকা হোসেন। চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মুজাহিদুর রহমানের আদালত এ সাজা ও পরোয়ানা ইস্যু করেন।
মামলা করেই ব্যাংকের দায় শেষ :ব্যাংকের ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার পর অর্থ আদায়ে মামলা করেই দায় সারে ব্যাংক। কারণ মামলা করার পর ঋণখেলাপিদের চাপে ফেলে অর্থ আদায়ের জন্য কোনো জোর তৎপরতাই চালায়নি ব্যাংকটি। ১৯৯০ সালের ১২ জানুয়ারি খেলাপি ঋণ আদায়ে জনতা ব্যাংক চট্টগ্রামের লালদীঘি করপোরেট শাখা অর্থঋণ মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ১ ডিসেম্বর ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আদালত ২ কোটি ৫ লাখ ৩৯ হাজার ১৮২ টাকার ডিক্রি ঘোষণা করেন। ৬০ দিনের মধ্যে ব্যাংককে এ অর্থ দিতে নির্দেশ দেন আদালত। নির্দিষ্ট সময়ে ডিক্রির অর্থ পরিশোধ না করায় ১৯৯২ সালের ২৩ নভেম্বর অর্থঋণ জারি মামলা দায়ের করেন। তার পর ২০০৩ সালের ১৪ অক্টোবর ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করেন আদালত। তাঁদের পরোয়ানা সীতাকুণ্ড থানায় পৌঁছানো এবং ঋণখেলাপিদের গ্রেপ্তার করার জন্য তৎপরতাই চালায়নি ব্যাংক। কারণ ২০০৩ সালের পরোয়ানা জারি হলেও ২০২২ সাল পর্যন্ত ২০ বছর সেই পরোয়ানা কার্যকর না হওয়ার বিষয়টি একবারের জন্যও আদালতের নজরে আনেনি ব্যাংক। একবারের জন্যও থানার সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়নি। ব্যাংকের এ ধরনের নীরবতার সুযোগ নিয়ে বছরের পর বছর খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে গেছেন এ ঋণখেলাপিরা।
যেভাবে সুদ মওকুফের তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংক :৩৩ বছর আগের পুরোনো খেলাপি ঋণের মামলায় শতভাগ সুদ মওকুফ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আদালত। ব্যাংক স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রচলিত ব্যাংকিং নীতিমালার মেনে এ সুদ মওকুফ করেছেন কিনা, তা জানতে চেয়েছেন। সুদ মওকুফের ঘটনাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালককে নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান। একই সঙ্গে আদেশে উল্লেখ করা হয়, ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে মূল ঋণ আদায় ব্যতীত সুদ মওকুফের যে মহোৎসব চলছে, তাতে দেশে ঋণখেলাপির সংস্কৃতি উৎসাহিত হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।’
সোর্স : সমকাল